#এক
“জুতো পাআআআলিইইইসসসসসস...”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ওহ বাবা... সাড়ে আটটা। এখনও খাওয়া বাকি। আজ মনে হচ্ছে পালিশ ছাড়াই অফিস দৌড়তে হবে। একবার উঁকি দিলাম দোতলার বারান্দা থেকে নিচে – হুম ঠিক আমাদের বাড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে এ পাড়ার এক চেটিয়া জুতো পালিশ ওয়ালা। বছর বিশেকের রানা। সেই এক ই ময়লাটে নীল লুঙ্গি, জুতোর কালি লাগা “এক কালে সাদা ছিল” গেঞ্জি, ডান কাঁধে একটা গামছা (মনে হয় মুখ মোছার জন্য), বাঁ কাঁধে এক খানা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, ডান হাতে জুতো পালিশের বাক্স। গত তিন বছরের চেনা মুখ। আমি আর আমার জুতোর চাকরি জীবন শুরু ওর হাতেই। বলা যায় ইন্টারভিউ থেকেই।
ইতস্তত করলাম ক্ষণিক। ডাকব ওকে? নাকি বেরিয়ে যাই? ষ্টেশন একবার শেষ চেষ্টা করব পালিশ টা করানোর... আজ আবার ক’টা কল এ বেরনোর ছিল। কি করব কি করব ভাবতে ভাবতে দেখি বাঁ দিক দিয়ে একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ –“ অ্যাই জুতো... এদিকে এদিকে...” রানা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রে বাবা আজ! “... মা... ও মা... দিলে খেতে?”
বাড়ি টা খুঁজে পেল মনে হয়। আমি কিছু বলার আগেই চলে গেল। ধুস। যাকগে, পরে দেখা যাবে। আবার ঘড়ি দেখলাম... উফ ন’টা দশের লোকাল টা মিস করব নাকি
#দুই
ডান জুতো টা ভাল করে হল রে রানা?”, সন্দেহের চোখে বললাম আমি, “সামনেটা হয়েছে ঠিক করে?” জুতোর সূচালো আগাটা ওর দিকে আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি। আজ আমার হাতে টাইম আছে। কাছেই লেক গার্ডেনস এ একজন ক্লাইন্ট। টাইম দিয়েছে দশটা। ট্রেন এ মিনিট পনের লাগবে। ডকুমেন্ট কালেক্ট করে অফিস ঢুকব। “ঠিক ই তো হইসিললো”, রানা বিরক্ত। তখনই মেয়েলি গলায় আওয়াজ টা কানে গেল... “ও ভাই, এদিকে... ও জুতো পালিশ... এদিকে এদিকে...”
“আসতিছিইই...” দৌড়ল রানা।
কোনদিক থেকে ডাকল? কেই বা ডাকছে এই সময়ে? এই আওয়াজ টা তো নতুন শুনছি... উঁকি মারলাম একটু বাঁ দিকের বাড়ি গুলোয়। কোন বাড়ির দিকে গেল রানা টা? ওই তো এগোচ্ছে... ওটা কি বিল্টুদের বাড়ি? একতলায় নতুন ভাড়া এল নাকি? ধুর যাকগে... পরে দেখব। আমার জুতো টা কি করল ঠিক করে ব্যাটা?
#তিন
“অ্যাই জুতোওলা... ও দাদা... এদিকে এসো না...” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আজও আওয়াজ টা পেলাম। আজ শনিবার। আমার অফিস ছুটি। সকালে যাচ্ছি একটু বাজার। বাবা কে শনি-রবি আর যেতে দিই না, আমিই করার চেষ্টা করি। ঘড়ি দেখলাম। ন’টা বেজে গেছে। শনিবার রানা একটু লেটে আসে। এমনিতেও আজ বিশেষ খরিদ্দার পাবে না, তবু রোজের ডিউটি। ছাড়ে না। জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে নিচে নেমে শুনছি মেয়েলি গলায় অনুনয়ের সুর,” আসো না গো, করে দাও না...” আর রানা কি সব বলছে গজর গজর করতে করতে।
এটা সেই বিল্টূ দের নতুন ভাড়াটে মেয়ে টার গলা না? আজ শনিবারও জুতো পালিশ লাগে করতে? কোথায় চাকরি করে কে জানে। কাল সুমন বলছিল ক্যারাম খেলতে খেলতে, বুড়ো বুড়ি আর একটা ছোট্ট মেয়ে থাকে। মেয়েটি বছর ছয়েক। কিছুদিন হল ভাড়া এসেছে বিল্টূ দের একতালায়।
-“ বুড়ো বুড়ি আর ছোট মেয়ে”, আমার জিগ্যাসু চোখে অবধারিত প্রশ্ন। সুমন একটা শ্রাগ করে চালে মন দিল। ওর সামনে তখন লাল ঘুটি। মাছের চোখ। আর হাতে অর্জুনের ধনুক।
#চার
-“অ্যাই রানা অ্যাই রানা, কি হল রে?” দৌড়ে গেলাম রানার পেছন পেছন। গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে যাচ্ছে পাড়া থেকে। শনিবারের বাজারে বউনি হয়নি বেচারার। তারপর কি হল কে জানে? মেয়েটা ডাকল তো শুনলাম, কিন্তু রানা অত রেগে উঠলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি ওই বুড়ো বুড়ীর? নাকি মেয়েটার? আমি যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি কৌতূহলী।
দৌড়ে রানা কে ধরে ফেললাম আমি। “কি ব্যাপার রে?”, বিল্টূ দের বাড়ির দিকে একবার উঁকি দিয়ে আমি রানা কে ধরলাম, “কি ব্যাপার? রাগ করে পালাচ্ছিস কেন? ওরা কিছু বলল নাকি তোকে?”
-“আর বোলোনাতো বড়দা,” রানার চোখে মুখে যতপরনাস্তি বিরক্তি। এই রোজদিন ডাক দিয়ে যাবে... এদিকে ধরাবে একখান পেলাস্টিকের জুতা পালিশ করতি!
-“প্লাস্টিক!” আমি হতভম্ব।“ প্লাস্টিক” মানে?
-“ যানি না, যাও।” উল্টে আমার উপর রেগে গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে গেল।
পাগল নাকি! মনে মনে ভাবলাম আমি। আর একবার উঁকি দিলাম বাড়িটার দিকে বাজার যেতে যেতে। নাহ। আজ সন্ধ্যেবেলা বলতে হচ্ছে সুমনদের। এতো জম্পেশ একখানা ব্রেকিং নিউজ!
#পাঁচ
সকালের ওই ঘটনার পর থেকেই মনটা উশখুশ করছে। ঠিক কি ব্যাপার খতিয়ে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হবে না। বাজার থেকে ফেরার পর থেকেই খালি মন চলে যাছে বিল্টূদের বাড়ির দিকে। প্লাস্টিকের জুতো পালিশ করতে দিচ্ছে! আজব ব্যাপার! নাহ। একটু দেখেই আসি। স্নান সেরে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ চলেই গেলাম। কিছু একটা বলে ঢুকতে হবে। কি বলি কি বলি? এই ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম। দরজা খোলাই। বিল্টূদের কাজের মেয়েটি উবু হয়ে বারান্দা মুছছে। আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কাউরে খুঁজতিছেন?” উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি।
-“ না মানে... হ্যাঁ মানে ওই আর কি...” কি বলব ঠাওর করতে পারছিলাম না। তখন ই ভেতর থেকে গলা পেলাম, “ কে রে ঝুমা?”
-“কেলাবের দাদা গো” বলে আমার উবু হয়ে মোছা শেষ করতে লাগল ঝুমা।
-“কে?”, ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক। বয়স হয়েছে। মাথা ভর্তি সাদা চুল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
মনে পরে গেল আমার। বেঁটে। বয়েসের ভারে একটু কুঁজো। পরনে খালি গায়ে পইতে আর একটা আলিগড়ী পাজামা।
-“আমি মানে... আমি এ পাড়াতেই থাকি। এই তিনটে বাড়ি পরেই...” সৌম্য ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক কি বলব বুঝে পাচ্ছিলাম না আমি, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল।
-“ভেতরে এসো।”
ঢুকতে যাচ্ছি, ওমা কোথা থেকে এক্তি বাচ্চা মেয়ে এসে আটকে দিল, “একি কি করছ কি করছ। এখুনি মুছে গেল না? পাড়া দিও না! সাইড সাইড দিয়ে এসো!” আমি শুনে অবাক! এতো দেখছি আমার দিদির মেয়ের মতই পাকা বুড়ি! ওর ই বয়েসি হবে মনে হচ্ছে। কতো বলেছিল যেন সুমন? ছয়? না সাত? ভাবতে ভাবতেই দেখি মেয়েটি কলকল করে বলে চলেছে, “ হ্যাঁ তো, আমি ঠিক বলছি তো। মা তো আমাকে শিখিয়েছে যে ভেজা ঘরে পা দিতে নেই...”
আমি হেসে না বোঝার ভান করে বললাম, “কি ভাবে যাব তাহলে? তুমি একটু দেখিয়ে দেবে?” বেশ মজা লাগছিল আমার। মেয়েটি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে তুলে দেখাতে লাগল আমার কেমন করে হাঁটা উচিৎ। হেসে উঠলাম আমরা। দেখলাম মেয়েটির পেছনে এক বয়স্ক মহিলা। নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের স্ত্রী। মেয়েটির দিদা। অথবা ঠাকুমা। ছোট্ট করে গাল টিপে আমি সোফায় বসলাম। ততখনে আমার সপ্রতিভতা ফিরে এসেছে। হেসে বললাম, “শুনলাম নতুন এসেছেন, তাই একটু দেখা করতে এলাম। কিছু অসুবিধা হলে জানাবেন কাকু”।
স্মিত হেসে আমার পাশে বসলেন ভদ্রলোক। “তোমার কাকিমা কে বলি? একটু চা খাবে তো?” আমি অপ্রস্তুত, “না না কাকিমা, কিছু লাগবে না।”
ওমা! দেখি টরটরি পৌঁছে গেছে। “খাও না, খাও না, দিদা খুব ভাল চা করে তো,”
গাল টিপে দিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি নাম তোমার?”
-“ভালনাম লিপ্সা, ডাকনাম নিনি। নি ফর নীলিমা। নি ফর নীলোৎপল। আমার মা আর আমার বাবা।”
-“বাহ, ভারি মিষ্টি নাম তো!”
-“আচ্ছা তুমি প্লেন বানাতে পারো?... দাঁড়াও” কৌতূহলী চোখ জোড়া আমার দিকে চেয়েই অপেক্ষা না করেই কিছু একটা আনতে চলে গেল ভেতরে।কাকু দেখলাম মুখ নিছু করে বসে। কিছু একটা ভাবছেন হয়ত। ঘরের চারিদিকটা দেখলাম আমি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। কোথাও তো কোন অ্যাবনরমালিটি দেখছি না। তাহলে রানাটাই কি কোনো ভুল করল? প্লাস্টিকের জুতো পালিশ?! মনে পরে গেল আমার। ভাবনা ভঙ্গ হল আমার, নিনি এসে গেছে একটা দুমড়ানো খবরের কাগজের একটা পাতা নিয়ে।
-“এই নাও, প্লেন বানিয়ে দাও।” নিনির হাসি হাসি মুখে মিষ্টি মিষ্টি পাকা কথা টুকুনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দিদির মেয়েটা আমাদের বাড়ি এলে সব সময়ে লেপটে থাকে আমাকে।
কাকিমা ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছেন। নিনির গায়ে মৃদু চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “নিনি, যাও ভেতরে যাও আমি আসছি।” নিনির যদিও যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি ভাল করে একটা প্লেন বানিয়ে সোঁ করে ছুড়ে দিলাম সিলিঙের দিকে তাক করে। নিনি ছুটে গেল ধরার জন্য। ধরে নিয়ে এসে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “ জানো কাকু, দাদু দিদা না পারে না প্লেন বানাতে। মা পারে।”
আমি হেসে বললাম, “হুঁ। মা কে বোলো একটা বানিয়ে দেবে।”
-“বলব।” হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল কি মেয়েটা? দরজার বাইরেটায় চোখ ওর তখন।
-“নিনি”, নিনির দিদা ভেতরে নিয়ে গেলেন ওকে, “চল স্নান করবে।”
কখন ফেরে ওর মা? আমার জিজ্ঞাসু চোখ। তবে যে সুমন বলেছিল শুধু বুড়ো বুড়ি আর বাচ্চা মেয়ে? প্রশ্ন করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক দেখছি উশখুশ করছেন। বুঝলাম যে উঠতে হবে। দু চুমুকে চা শেষ করে আমি উঠে পড়লাম।
- “আসি কাকু। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন।” বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম আমি।
- “আসলে..., কাকু কিছু বলতে চাইলেন। ইতস্তত করছেন। “বলুন না”, পায়ে চটি গলাতে গলাতে বললাম।
- “আসলে, নিনির বাবা মা নেই... মানে, মাস ছয়েক হল, মারা গেছে।”
চমকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। কি বলছে কি লোকটা? মারা গেছে? এই ছোট্ট নিনির বাবা মা? নেই? তারা নেই? টুকুনেরই মত। চুলবুলে। টরটরি। দুদিকে দুটো ঝুটি। “কি বলছেন কি?” আমি বেরোতে পারলাম না। ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়।
-“আমার ছেলে বউ। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট... নিনি বেঁচে গেছিল... তবে... তবে মাথায় চোট পেয়েছিল খুব। তিন মাস যমে মানুষে টানাটানি... ফিরে এসেছে... আমাদের এখন ওই একজন ই...” গলা ধরে এল ভদ্রলোকের। চোখের কোল মুছলেন। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ভেতরের ঘরে উঁকি দিলাম। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিনি কে। স্নান হয়ে গেছে ততক্ষণে। বকর বকর করে যাচ্ছে। আর দিদা চুল আঁচড়ে দিচ্ছে।
আর কোন কথা বলতে পারলাম না আমি। এক পা এক পা করে বেরিয়ে আসলাম। পেছন পেছন কাকু। হঠাৎ রানার মুখ টা মনে পড়ল আমার। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাকুর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা কাকু। রানা বলছিল... মানে জুতো পালিশ ছেলে টা... বলছিল আপনারা প্লাস্টিকের জুতো দেন পালিশ করতে...!!!”
আমার দিকে এক পলক তাকালেন কাকু। “বাধ্য হয়ে”, মাথা নিছু করে বললেন কাকু। “বাধ্য হয়ে ডাকতে হয়। অ্যাকসিডেন্টের দিন স্কুলের প্রথম দিন ছিল নিনির। সকালে ওর মা খুব যত্ন করে জুতো পালিশ করে দিয়েছিল। সেটা মনে গেঁথে আছে নিনির। যে কোন পালিশওলা কে দেখলেই ও ওর মায়ের জুতো দিয়ে পালিশ করতে বলে। ওর মায়ের একটাই জুতো আছে এবাড়ী। একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডল। ওটা ওর খুব প্রিয়। আসলে নিনি পুরোপুরি সুস্থ নয়... অ্যাক্সিডেন্টে ও খুব চোট পেয়েছিল মাথায়। ওই সময়ের সব স্মৃতি মুছে গেছে ওর। ও বিশ্বাস করে ওর বাবা মা অফিস গেছে। ফিরে আসবে সন্ধেবেলা। আমরাও হয়ত সেই আসাতেই আছি... ফিরে আসবে ওরা কোনোদিন...” গলা ধরে এল ওনার।
বেরিয়ে পড়লাম আমি। গনগনে রোদ্দুর মাথার উপর। কেউ কোথাও নেই। বাড়ির দিকে এগলাম। সামনে টুকুন। পেছনে নিনি। জুতো পালিশের রঙ এখন আমারও চোখে।
“জুতো পাআআআলিইইইসসসসসস...”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ওহ বাবা... সাড়ে আটটা। এখনও খাওয়া বাকি। আজ মনে হচ্ছে পালিশ ছাড়াই অফিস দৌড়তে হবে। একবার উঁকি দিলাম দোতলার বারান্দা থেকে নিচে – হুম ঠিক আমাদের বাড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে এ পাড়ার এক চেটিয়া জুতো পালিশ ওয়ালা। বছর বিশেকের রানা। সেই এক ই ময়লাটে নীল লুঙ্গি, জুতোর কালি লাগা “এক কালে সাদা ছিল” গেঞ্জি, ডান কাঁধে একটা গামছা (মনে হয় মুখ মোছার জন্য), বাঁ কাঁধে এক খানা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, ডান হাতে জুতো পালিশের বাক্স। গত তিন বছরের চেনা মুখ। আমি আর আমার জুতোর চাকরি জীবন শুরু ওর হাতেই। বলা যায় ইন্টারভিউ থেকেই।
ইতস্তত করলাম ক্ষণিক। ডাকব ওকে? নাকি বেরিয়ে যাই? ষ্টেশন একবার শেষ চেষ্টা করব পালিশ টা করানোর... আজ আবার ক’টা কল এ বেরনোর ছিল। কি করব কি করব ভাবতে ভাবতে দেখি বাঁ দিক দিয়ে একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ –“ অ্যাই জুতো... এদিকে এদিকে...” রানা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রে বাবা আজ! “... মা... ও মা... দিলে খেতে?”
বাড়ি টা খুঁজে পেল মনে হয়। আমি কিছু বলার আগেই চলে গেল। ধুস। যাকগে, পরে দেখা যাবে। আবার ঘড়ি দেখলাম... উফ ন’টা দশের লোকাল টা মিস করব নাকি
#দুই
ডান জুতো টা ভাল করে হল রে রানা?”, সন্দেহের চোখে বললাম আমি, “সামনেটা হয়েছে ঠিক করে?” জুতোর সূচালো আগাটা ওর দিকে আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি। আজ আমার হাতে টাইম আছে। কাছেই লেক গার্ডেনস এ একজন ক্লাইন্ট। টাইম দিয়েছে দশটা। ট্রেন এ মিনিট পনের লাগবে। ডকুমেন্ট কালেক্ট করে অফিস ঢুকব। “ঠিক ই তো হইসিললো”, রানা বিরক্ত। তখনই মেয়েলি গলায় আওয়াজ টা কানে গেল... “ও ভাই, এদিকে... ও জুতো পালিশ... এদিকে এদিকে...”
“আসতিছিইই...” দৌড়ল রানা।
কোনদিক থেকে ডাকল? কেই বা ডাকছে এই সময়ে? এই আওয়াজ টা তো নতুন শুনছি... উঁকি মারলাম একটু বাঁ দিকের বাড়ি গুলোয়। কোন বাড়ির দিকে গেল রানা টা? ওই তো এগোচ্ছে... ওটা কি বিল্টুদের বাড়ি? একতলায় নতুন ভাড়া এল নাকি? ধুর যাকগে... পরে দেখব। আমার জুতো টা কি করল ঠিক করে ব্যাটা?
#তিন
“অ্যাই জুতোওলা... ও দাদা... এদিকে এসো না...” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আজও আওয়াজ টা পেলাম। আজ শনিবার। আমার অফিস ছুটি। সকালে যাচ্ছি একটু বাজার। বাবা কে শনি-রবি আর যেতে দিই না, আমিই করার চেষ্টা করি। ঘড়ি দেখলাম। ন’টা বেজে গেছে। শনিবার রানা একটু লেটে আসে। এমনিতেও আজ বিশেষ খরিদ্দার পাবে না, তবু রোজের ডিউটি। ছাড়ে না। জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে নিচে নেমে শুনছি মেয়েলি গলায় অনুনয়ের সুর,” আসো না গো, করে দাও না...” আর রানা কি সব বলছে গজর গজর করতে করতে।
এটা সেই বিল্টূ দের নতুন ভাড়াটে মেয়ে টার গলা না? আজ শনিবারও জুতো পালিশ লাগে করতে? কোথায় চাকরি করে কে জানে। কাল সুমন বলছিল ক্যারাম খেলতে খেলতে, বুড়ো বুড়ি আর একটা ছোট্ট মেয়ে থাকে। মেয়েটি বছর ছয়েক। কিছুদিন হল ভাড়া এসেছে বিল্টূ দের একতালায়।
-“ বুড়ো বুড়ি আর ছোট মেয়ে”, আমার জিগ্যাসু চোখে অবধারিত প্রশ্ন। সুমন একটা শ্রাগ করে চালে মন দিল। ওর সামনে তখন লাল ঘুটি। মাছের চোখ। আর হাতে অর্জুনের ধনুক।
#চার
-“অ্যাই রানা অ্যাই রানা, কি হল রে?” দৌড়ে গেলাম রানার পেছন পেছন। গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে যাচ্ছে পাড়া থেকে। শনিবারের বাজারে বউনি হয়নি বেচারার। তারপর কি হল কে জানে? মেয়েটা ডাকল তো শুনলাম, কিন্তু রানা অত রেগে উঠলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি ওই বুড়ো বুড়ীর? নাকি মেয়েটার? আমি যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি কৌতূহলী।
দৌড়ে রানা কে ধরে ফেললাম আমি। “কি ব্যাপার রে?”, বিল্টূ দের বাড়ির দিকে একবার উঁকি দিয়ে আমি রানা কে ধরলাম, “কি ব্যাপার? রাগ করে পালাচ্ছিস কেন? ওরা কিছু বলল নাকি তোকে?”
-“আর বোলোনাতো বড়দা,” রানার চোখে মুখে যতপরনাস্তি বিরক্তি। এই রোজদিন ডাক দিয়ে যাবে... এদিকে ধরাবে একখান পেলাস্টিকের জুতা পালিশ করতি!
-“প্লাস্টিক!” আমি হতভম্ব।“ প্লাস্টিক” মানে?
-“ যানি না, যাও।” উল্টে আমার উপর রেগে গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে গেল।
পাগল নাকি! মনে মনে ভাবলাম আমি। আর একবার উঁকি দিলাম বাড়িটার দিকে বাজার যেতে যেতে। নাহ। আজ সন্ধ্যেবেলা বলতে হচ্ছে সুমনদের। এতো জম্পেশ একখানা ব্রেকিং নিউজ!
#পাঁচ
সকালের ওই ঘটনার পর থেকেই মনটা উশখুশ করছে। ঠিক কি ব্যাপার খতিয়ে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হবে না। বাজার থেকে ফেরার পর থেকেই খালি মন চলে যাছে বিল্টূদের বাড়ির দিকে। প্লাস্টিকের জুতো পালিশ করতে দিচ্ছে! আজব ব্যাপার! নাহ। একটু দেখেই আসি। স্নান সেরে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ চলেই গেলাম। কিছু একটা বলে ঢুকতে হবে। কি বলি কি বলি? এই ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম। দরজা খোলাই। বিল্টূদের কাজের মেয়েটি উবু হয়ে বারান্দা মুছছে। আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কাউরে খুঁজতিছেন?” উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি।
-“ না মানে... হ্যাঁ মানে ওই আর কি...” কি বলব ঠাওর করতে পারছিলাম না। তখন ই ভেতর থেকে গলা পেলাম, “ কে রে ঝুমা?”
-“কেলাবের দাদা গো” বলে আমার উবু হয়ে মোছা শেষ করতে লাগল ঝুমা।
-“কে?”, ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক। বয়স হয়েছে। মাথা ভর্তি সাদা চুল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
মনে পরে গেল আমার। বেঁটে। বয়েসের ভারে একটু কুঁজো। পরনে খালি গায়ে পইতে আর একটা আলিগড়ী পাজামা।
-“আমি মানে... আমি এ পাড়াতেই থাকি। এই তিনটে বাড়ি পরেই...” সৌম্য ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক কি বলব বুঝে পাচ্ছিলাম না আমি, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল।
-“ভেতরে এসো।”
ঢুকতে যাচ্ছি, ওমা কোথা থেকে এক্তি বাচ্চা মেয়ে এসে আটকে দিল, “একি কি করছ কি করছ। এখুনি মুছে গেল না? পাড়া দিও না! সাইড সাইড দিয়ে এসো!” আমি শুনে অবাক! এতো দেখছি আমার দিদির মেয়ের মতই পাকা বুড়ি! ওর ই বয়েসি হবে মনে হচ্ছে। কতো বলেছিল যেন সুমন? ছয়? না সাত? ভাবতে ভাবতেই দেখি মেয়েটি কলকল করে বলে চলেছে, “ হ্যাঁ তো, আমি ঠিক বলছি তো। মা তো আমাকে শিখিয়েছে যে ভেজা ঘরে পা দিতে নেই...”
আমি হেসে না বোঝার ভান করে বললাম, “কি ভাবে যাব তাহলে? তুমি একটু দেখিয়ে দেবে?” বেশ মজা লাগছিল আমার। মেয়েটি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে তুলে দেখাতে লাগল আমার কেমন করে হাঁটা উচিৎ। হেসে উঠলাম আমরা। দেখলাম মেয়েটির পেছনে এক বয়স্ক মহিলা। নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের স্ত্রী। মেয়েটির দিদা। অথবা ঠাকুমা। ছোট্ট করে গাল টিপে আমি সোফায় বসলাম। ততখনে আমার সপ্রতিভতা ফিরে এসেছে। হেসে বললাম, “শুনলাম নতুন এসেছেন, তাই একটু দেখা করতে এলাম। কিছু অসুবিধা হলে জানাবেন কাকু”।
স্মিত হেসে আমার পাশে বসলেন ভদ্রলোক। “তোমার কাকিমা কে বলি? একটু চা খাবে তো?” আমি অপ্রস্তুত, “না না কাকিমা, কিছু লাগবে না।”
ওমা! দেখি টরটরি পৌঁছে গেছে। “খাও না, খাও না, দিদা খুব ভাল চা করে তো,”
গাল টিপে দিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি নাম তোমার?”
-“ভালনাম লিপ্সা, ডাকনাম নিনি। নি ফর নীলিমা। নি ফর নীলোৎপল। আমার মা আর আমার বাবা।”
-“বাহ, ভারি মিষ্টি নাম তো!”
-“আচ্ছা তুমি প্লেন বানাতে পারো?... দাঁড়াও” কৌতূহলী চোখ জোড়া আমার দিকে চেয়েই অপেক্ষা না করেই কিছু একটা আনতে চলে গেল ভেতরে।কাকু দেখলাম মুখ নিছু করে বসে। কিছু একটা ভাবছেন হয়ত। ঘরের চারিদিকটা দেখলাম আমি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। কোথাও তো কোন অ্যাবনরমালিটি দেখছি না। তাহলে রানাটাই কি কোনো ভুল করল? প্লাস্টিকের জুতো পালিশ?! মনে পরে গেল আমার। ভাবনা ভঙ্গ হল আমার, নিনি এসে গেছে একটা দুমড়ানো খবরের কাগজের একটা পাতা নিয়ে।
-“এই নাও, প্লেন বানিয়ে দাও।” নিনির হাসি হাসি মুখে মিষ্টি মিষ্টি পাকা কথা টুকুনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দিদির মেয়েটা আমাদের বাড়ি এলে সব সময়ে লেপটে থাকে আমাকে।
কাকিমা ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছেন। নিনির গায়ে মৃদু চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “নিনি, যাও ভেতরে যাও আমি আসছি।” নিনির যদিও যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি ভাল করে একটা প্লেন বানিয়ে সোঁ করে ছুড়ে দিলাম সিলিঙের দিকে তাক করে। নিনি ছুটে গেল ধরার জন্য। ধরে নিয়ে এসে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “ জানো কাকু, দাদু দিদা না পারে না প্লেন বানাতে। মা পারে।”
আমি হেসে বললাম, “হুঁ। মা কে বোলো একটা বানিয়ে দেবে।”
-“বলব।” হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল কি মেয়েটা? দরজার বাইরেটায় চোখ ওর তখন।
-“নিনি”, নিনির দিদা ভেতরে নিয়ে গেলেন ওকে, “চল স্নান করবে।”
কখন ফেরে ওর মা? আমার জিজ্ঞাসু চোখ। তবে যে সুমন বলেছিল শুধু বুড়ো বুড়ি আর বাচ্চা মেয়ে? প্রশ্ন করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক দেখছি উশখুশ করছেন। বুঝলাম যে উঠতে হবে। দু চুমুকে চা শেষ করে আমি উঠে পড়লাম।
- “আসি কাকু। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন।” বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম আমি।
- “আসলে..., কাকু কিছু বলতে চাইলেন। ইতস্তত করছেন। “বলুন না”, পায়ে চটি গলাতে গলাতে বললাম।
- “আসলে, নিনির বাবা মা নেই... মানে, মাস ছয়েক হল, মারা গেছে।”
চমকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। কি বলছে কি লোকটা? মারা গেছে? এই ছোট্ট নিনির বাবা মা? নেই? তারা নেই? টুকুনেরই মত। চুলবুলে। টরটরি। দুদিকে দুটো ঝুটি। “কি বলছেন কি?” আমি বেরোতে পারলাম না। ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়।
-“আমার ছেলে বউ। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট... নিনি বেঁচে গেছিল... তবে... তবে মাথায় চোট পেয়েছিল খুব। তিন মাস যমে মানুষে টানাটানি... ফিরে এসেছে... আমাদের এখন ওই একজন ই...” গলা ধরে এল ভদ্রলোকের। চোখের কোল মুছলেন। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ভেতরের ঘরে উঁকি দিলাম। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিনি কে। স্নান হয়ে গেছে ততক্ষণে। বকর বকর করে যাচ্ছে। আর দিদা চুল আঁচড়ে দিচ্ছে।
আর কোন কথা বলতে পারলাম না আমি। এক পা এক পা করে বেরিয়ে আসলাম। পেছন পেছন কাকু। হঠাৎ রানার মুখ টা মনে পড়ল আমার। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাকুর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা কাকু। রানা বলছিল... মানে জুতো পালিশ ছেলে টা... বলছিল আপনারা প্লাস্টিকের জুতো দেন পালিশ করতে...!!!”
আমার দিকে এক পলক তাকালেন কাকু। “বাধ্য হয়ে”, মাথা নিছু করে বললেন কাকু। “বাধ্য হয়ে ডাকতে হয়। অ্যাকসিডেন্টের দিন স্কুলের প্রথম দিন ছিল নিনির। সকালে ওর মা খুব যত্ন করে জুতো পালিশ করে দিয়েছিল। সেটা মনে গেঁথে আছে নিনির। যে কোন পালিশওলা কে দেখলেই ও ওর মায়ের জুতো দিয়ে পালিশ করতে বলে। ওর মায়ের একটাই জুতো আছে এবাড়ী। একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডল। ওটা ওর খুব প্রিয়। আসলে নিনি পুরোপুরি সুস্থ নয়... অ্যাক্সিডেন্টে ও খুব চোট পেয়েছিল মাথায়। ওই সময়ের সব স্মৃতি মুছে গেছে ওর। ও বিশ্বাস করে ওর বাবা মা অফিস গেছে। ফিরে আসবে সন্ধেবেলা। আমরাও হয়ত সেই আসাতেই আছি... ফিরে আসবে ওরা কোনোদিন...” গলা ধরে এল ওনার।
বেরিয়ে পড়লাম আমি। গনগনে রোদ্দুর মাথার উপর। কেউ কোথাও নেই। বাড়ির দিকে এগলাম। সামনে টুকুন। পেছনে নিনি। জুতো পালিশের রঙ এখন আমারও চোখে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন