এক
আমার নতুন মাস্টারমশাই শিশিরবাবু। বাবা অবশ্য ওনাকে বাবু বলতে বারণ করেছেন, উনি নাকি বাবার ছেলেবেলার বন্ধু। কিন্তু কি করবো! কাকু ভেবেই তো বসেছিলাম আজ পড়ার ঘরে সেই সওয়া ছটা থেকে। কাঁটায় কাঁটায় ৬.৩০র সময় যিনি ঢুকলেন তাঁকে দেখে কাকু সম্বোধনটা গলাতেই আটকে গেল। অনেক টানা-হ্যাঁচরা করেও তাকে আর মুখ থেকে বের করতে পারলাম না।
বাবার মুখে এনার সম্পর্কে অনেক গল্পই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। উনি নাকি খেলাধূলাতেও যেমন ভাল ছিলেন, পড়াশোনাতেও সেরকমই এক নম্বর। "তা এতই যখন বন্ধুত্ব, একদিন বাড়িতে ডাকলে পার তো। আজ পর্যন্ত কৈ তাকে তো চোখেই দেখলাম না" বাবার স্মৃতি রোমন্থনের পর মা মাঝে মাঝেই বলে উঠত। বাবার উত্তরটা একই থাকত সবসময়। ম্লান হেসে বাবা বলত, "বললেই যদি আসত তাহলে তো হয়েই যেত। যা মুখচোরা। তাছাড়া সারাদিন এদিক ওদিক ছাত্র পড়িয়ে বেড়ায়। ঐ করেই তো সংসার চালায়।"
তা গত পরীক্ষায় ফিজিক্সে আমার অসামান্য ফলের পর কপালে বকাবকি ছাড়া মাস্টারমশাই বদলও যে আছে তা একরকম স্কুলে খাতাটা হাতে পাওয়া মাত্রই আন্দাজ করেছিলাম। মুখ কালো করে বাড়ি ঢোকাতেই মার যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছিল। 'দাঁড়াও, আজ বাবা ফিরুক। হচ্ছে তোমার।" মার রুদ্রমূর্তি দেখে আমি আর কথা বাড়াইনি। কি দরকার, বকার উপর দিয়ে গেছে। এর বেশী খেপে গেলে থাপ্পড় জুটবে কপালে। বাবাকে তো চিনিই। চুপচাপ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরীক্ষা খারাপ হয়েছে বলে কি আর ভাত-ঘুম নষ্ট করা যায়!
আমার বাবা চিরকালই নিরীহ। বকবে না জানতাম, তবে মার মুখে আমার নম্বরের ফিরিস্তি শুনে যে বাবার মুখ টাও এমন অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে যাবে সেটা বুঝতে পারিনি।
তো অবশেষে আমার কল্যাণেই শিশিরবাবুর এ বাড়িতে পদার্পণ।
দুই
"তোমার বাবা বলছিল যে তুমি এতটা খারাপ নম্বর পাওয়ার মতো ছাত্র নও। তা হঠাৎ নম্বর এত কম হল কেন?"
ভয় পাচ্ছিলাম এই ধরণের প্রশ্ন যদি করে বসেন। বলতে কি আর পারব যে ক্লাসে আসা নতুন মেয়েটার জন্যে আজকাল আর পড়ায় মন বসে না! যতই হোক বাবার বন্ধু। যদি বলে দেয়?
গম্ভীর মানুষটি কে দেখে আমার তো গলা শুকিয়ে কাঠ। খেয়েছে! আমার তো কপালে বেশ দুঃখ আছে মনে হচ্ছে। আমার এইসব চিন্তাভাবনার মাঝে দেখি উনি কখন আমার সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়েছেন। অসম্ভব তীক্ষ্ণ দুটো চোখ দিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছেন আমারই দিকে। সে দৃষ্টি আমাকে কেন, আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ডানপিটে ছেলে বিনয়কেও ঠান্ডা করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট, আমি তো কোন ছাড়।
"তোমার বাবাকে ছোটবেলায় ঠিক তোমার মতন দেখতে ছিল।" বলতে চাইলাম, আমি তো এখন আর ছোট নেই, ১৫বছর বয়স আমার। এটা বলব না বলবনা ভাবতে ভাবতেই দেখি উনি বই নিয়ে পাতা উল্টাতে আরম্ভ করেছেন। আমার দিকে চেয়ে হালকা হেসে বললেন "কি, ওরাম ভ্যাবলাকান্তর মত বসে থাকলে চলবে? চল, শুরু করা যাক।"
আমার ভয় গুলো একটাও সত্যি হয়নি। দীর্ঘ, শীর্ণ, সামান্য ঝুঁকে পরা মানুষটা আমায় কোনও অস্বস্তিতে তো ফেললেনই না, উল্টে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমার বন্ধুর মতো হয়ে উঠলেন। পদার্থবিজ্ঞানে তো বটেই, অন্যান্য অনেক বিষয়েই ওনার অগাধ জ্ঞান। আজকাল পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অনেক গল্প করি। কিন্তু কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারি না যে বাবার বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে এত বয়স্ক লাগে কেন! কোথায় যেন বাধে। যদি কিছু মনে করে বসেন। বাবা বলেন কোনও মানুষের চেহারা নিয়ে কখনও কিছু বলা উচিত না। কিন্তু একজন ১৫বছর বয়সীর পক্ষে তার অদম্য কৌতুহল চেপে রাখাটা অত সহজ কাজ নয়। তা আমিও এমন কোনো মহাপুরুষ নই যে আমার দ্বারা এই অসাধ্যসাধন হবে।
তিন
সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হওয়ায় মা আর স্কুলে পাঠায়নি। আমিও মজা পেয়ে গেছিলাম। সারা দুপুর ধরে ফেমাস ফাইভদের কাণ্ডকারখানা পড়তে পড়তে সময়ের হুঁশ ছিল না। দেখি আমার অজান্তে ঘড়ির কাঁটা কখন সাড়ে ছ’টার দিকে অলস পায়ে এগিয়ে গেছে। যথা সময়ে শিশিরবাবুও এলেন। আমার পড়াও শুরু হল। কিন্তু মন বসাতে পারছিলাম না কিছুতেই। জুলিয়ান, ডিক, অ্যান আর জর্জের মতো আমারও মাথায় গোয়েন্দাগিরির ভুত চেপে গেছিল।
"আজ কি হয়েছে তোমার? এত উশখুশ করছ কেন? পড়ায় মন নেই মনে হচ্ছে।"
"আমার না আসলে একটা জিনিস জানার ছিল।"
"কি জিনিস?"
"আপনাকে এত বুড়ো লাগে কেন?"
"কারণটা জানলে কি পড়ায় মন বসবে?" যাক, রাগ করেননি তালে।
"বসবে।"
"সারাদিন রোদে রোদে ঘুরি তো, তাই।
"তা আপনি চাকরি করলেন না কেন? তাহলে তো আর রোদে ঘুরতে হত না।"
"সবাই যদি চাকরি করে তাহলে ছেলে-মেয়েদের পড়াবে কে বলো। এবার তুমি বলবে তাহলে স্কুল কলেজে পড়ালাম না কেন। কি, ঠিক তো?"
কি আর করব, আস্তে করে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম।
"তোমার স্কুলে যদি সব পড়াশোনা হয়ে যেত, তাহলে কি আর তোমার বাবা মা বাড়িতে মাস্টার রাখত?"
সেদিন আর পড়া বেশী দূর এগোয়নি। কিছুক্ষণ এটা ওটা কথা বলে উনি চলে গেলেন। আমারও ঠিক ভালো লাগছিল না। কোথায় যেন একটা অমিল। আমায় কথাগুলো উনি হালকা হেসে মজা করার মতো করে বললেন বটে, কিন্তু ওঁর চোখ যে সে কথা বলার পর কোন এক হারিয়ে যাওয়া দিনের চিন্তায় ঝাপসা হয়ে গেছিল তা আমার চোখ এড়ায়নি। ঠিক করলাম, সত্যিটা আমায় কিছু করে খুঁজে বের করতেই হবে।
চার
এরপর বেশ কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। ততদিনে বর্ষার অঝোর ধারায় আমার উত্তর কলকাতার এই ছোট্ট পাড়াটার একেবারে কাকভেজা অবস্থা। সারাদিন বৃষ্টিতে ক্লান্ত গৃহস্থের হেঁশেল খিচুড়ির গন্ধে ম ম করছে। সেরকমই এক একলা রবিবারের দুপুর। আমাদের বাড়িটা বানিয়েছিলেন আমার ঠাকুরদা, প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। মোটা মোটা দু-ইট সমান দেওয়াল, পুরু সেগুন কাঠের দরজা-জানালা – সেসব তো ছিলই। তার সাথে ছিল বাড়িতে যেটা আমার সমবয়সী প্রত্যেক ছেলের সবথেকে পছন্দের জায়গা – চিলেকোঠা। এই চিলেকোঠা ছিল আমার সমস্ত নির্জন দুপুরের সঙ্গী। বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। সেদিনও সেখানে বসে জানালা দিয়ে নিচের রাস্তা দেখছিলাম। পাশের বাড়ির বিনি এক মনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে বেসুরে গেয়ে চলেছিল “গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ”। এই পরিস্থিতিতে গানটা আদৌ মানায় কিনা ভাবতে ভাবতে চোখ পড়ল পাশে স্তূপাকার করা কিছু কাগজপত্র ও বাক্স-প্যাঁটরা। কিছুই করার নেই, তাই ভাবলাম ওই নিয়েই ঘাঁটি, যদি ভাল পড়ার মতো কোন গল্পের বই পাওয়া যায়।
কিছু পুরনো খবরের কাগজ সরানোর পর হাতে এল একটা কালো বাক্স। এহ, পুরো জং ধরে এঁটে গেছে একেবারে। ছুটে নিচে থেকে স্ক্রু-ড্রাইভার নিয়ে এসে চলল বাক্স খোলার প্রচেষ্টা। এক সময় খুলল সেই অভিমানী বাক্স। ততক্ষণে আমার একেবারে ঘর্মাক্ত অবস্থা। খুলে যা পেলাম তাতে বেশ অবাক হতে হল। বাবা মায়ের বিয়ের ও বউভাতের নিমন্ত্রনপত্র। দেওঘর থেকে লেখা বাবার কোন এক মাসির বিয়েতে না আসতে পারার চিঠি। শিশিরবাবুর লেখা একটা চিঠি। বিয়েতে না আসতে পেরে উনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
“প্রিয় বাবলু,
আমার শরীরের অবস্থা তো তোর অবগত। এখনও পুরোপুরি সেরে উঠিনিরে। কবে আবার চলতে পারব তাও জানিনা। তুই তো জানিস এ জিনিস সহজে ঠিক হবার নয়। সারাজীবনের জন্যে পঙ্গু যে হয়ে যেতে হয়নি সে কেবল আমার বাবার জন্যে। কী ভুত যে চেপেছিল মাথায় জানিনা। তোর পরিবারের কাছে আজীবন ঋণী থাকব রে, জীবনের ওই টালমাটাল সময়ে আর কেউ হয়তো আমায় আশ্রয় দিতনা। তোর খুশির দিনে তোর পাশে থাকতে পারলাম না সে আমার একান্ত দুর্ভাগ্য। আশা করি আমায় ক্ষমা করবি। বোনের হাতে এই চিঠির সাথে শঙ্করের চৌরঙ্গী বইটাও পাঠালাম। পরিস, জানি তোর ভাল লাগবে।
সুখে থাকিস, ভাল থাকিস।
ইতি,
শিশির”
চিঠিটা হাতে নিয়ে কতক্ষণ বসেছিলাম কে জানে। মশার কামড়ে চটকা ভাঙল। দেখি বিকেল হয়ে গেছে। বৃষ্টি আর পরছে না। বহুদিন পর আকাশের মেঘ কেটে গিয়ে সূর্যাস্তের গেরুয়া বসনে চারিদিক ছেয়ে গেছে। নিচে নামতেই দেখি বাবা বসার ঘরে চা হাতে নিয়ে বসে বাইরে চেয়ে আছেন। আমি পাশে গিয়ে বসতে খুব একটা হুঁশ হল না।
“বাবা!”
“হুহ! কিছু বলছ?”
“চিলেকোঠাতে এই চিঠিটা পেলাম।”
চিঠিটা দেখে বাবা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা নামিয়ে জোর করে মুখে হাসি এনে বলল, “দেখিস কাপটা ফেলিস না। তোর মা তাহলে বাড়ি মাথায় করবে”।
“ওনার কি হয়েছিল বাবা? কি অসুখ করেছিল?”
বাবা কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইল। বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভিতরে ভিতরে যে এক চিন্তার ঝড় বইছে তা বেশ বুঝতে পারলাম। আর এও বুঝলাম যে আমার আশঙ্কাই সঠিক। কিছু একটা গন্ডগোল তো আছেই। এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হল বাবার পরের কথায়।
"তোর পড়াশোনা নেই? সারা দুপুর কি ধুলো ঘেঁটেই কাটিয়ে দিলি নাকি? সামনে পরীক্ষা আসছে না? যা পড়তে বোস। এসব নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।"
বাবার গলায় এই স্বর আমার সম্পূর্ণ অচেনা। দুঃখ পেলাম। কী এমন ব্যাপার যা আমার থেকে চেপে রাখার জন্য বাবা এইভাবে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। পেছন ফিরে দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মা। মার মুখেও খানিক বিস্ময়। বাবাকে এভাবে রুক্ষ স্বরে কথা বলতে বোধহয় মাও খুব একটা শোনেনি। আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পড়ার ঘরে এসে বসলাম। কিছু পরে সদর দরজার খোলা-বন্ধের আওয়াজ শুনে বুঝলাম বাবার আড্ডা মারতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।
পাঁচ
বাবার কাছে বকুনি খাওয়াতে আমি একেবারেই অভ্যস্ত নই। তাও এরকম তুচ্ছ কারণে। কষ্ট হচ্ছিল। যে বাবা কোনোদিন আমায় বকেনা, আমি হাজার দুষ্টুমি করলেও যার মুখে হাসি লেগেই থাকে, তার আজ হঠাৎ কী হলো। কৌতুহল হওয়া তো খারাপ নয়, বাবাই তো শিখিয়েছে। তাহলে আজ আমি এমন কী দোষ করে ফেললাম! এইসব নানান চিন্তায় আমার সেদিন রাতে ঘুম আসছিল না। রাত তখন কত জানি না। অন্ধকারে ঘড়িও দেখতে পাচ্ছি না। বাইরের ঘরে আওয়াজ না পেয়ে ভাবলাম মা-বাবা এতক্ষণে নিশ্চয় শুয়ে পড়েছে।
বাবা আড্ডা দিয়ে ফেরার পর আমি আর অভিমান করে বাবার সাথে দেখা করিনি। রাতের খাবারও খেয়েছি নিজের ঘরে। এখন হঠাৎ জলতেষ্টা পাওয়ায় ভাবলাম যাই গিয়ে একটু জল খেয়ে আসি। বাইরের টেবিল থেকে বোতল নিয়ে জল খেতে গিয়ে পাশে বাবা-মার ঘর থেকে একটা মৃদু গুঞ্জন কানে এলো। মনে হল যেন মা একবার আমার নাম নিল। কী মনে হতে এগিয়ে গেলাম দরজার পাশে। যা শুনলাম তাতে মনে হল যেন আমার মনের উপর টাঙিয়ে রাখা একটা কালো পর্দাকে টেনে সরিয়ে দেওয়া হল।
"আজ বাবুকে শুধু শুধু ওরকমভাবে বকলে কেন? ও তো ভুল কিছু জিজ্ঞেস করেনি!"
"সত্যিটাই বা কী করে বলতাম বল। ও তো এখনও অনেক ছোট। আরেকটু বড় হলে তাও বুঝত।"
"সত্যিটা কি?"
"ওকে পুলিশে মেরেছিল, বড্ড মেরেছিল।"
বাবার গলা যেন খানিকটা বুজে এল। কিছুক্ষণের নিরবতা। বাকিটা শোনা আমার উচিত হবে কিনা ভাবতে ভাবতেই দেখি বাবা আবার বলতে শুরু করেছে।
“তখন আমরা কলেজে পরি। আমি কমার্স, ও ফিজিক্স। হঠাৎ একদিন বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় বলল যে ও নকশালে নাম লেখাচ্ছে। অনেক বারণ করলাম। শুনল না, উল্টে রেগে গেল। ওর বাবা ছিলেন তখনকার দিনের এক মস্ত বড় উকিল। ওঁর ভয়ে আমরা বন্ধুরা বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতাম। যেমন সাহেবি মেজাজ, তেমনই তাঁর অহংকার। সেই বাপের ছেলে কিনা নকশালে নাম লেখাবে। সে তার কি রাগ তখন। আমি ওর এতদিনের বন্ধু হয়েও কেন ওকে সমর্থন করছি না। বুঝল না যে অত আদর-যত্নে মানুষ হওয়া একজনের পক্ষে ওই কঠিন জীবন বেচে নেওয়াটা কত শক্ত।
বেশ কয়েক মাস পাত্তা নেই। বাড়িতেও নাকি থাকে না। চিন্তায় চিন্তায় ওর বাড়ির লোকের জেরবার অবস্থা। একদিন ওর বাবা আমায় ডেকে পাঠালেন। সৌম্যদর্শন মানুষটি দেখলাম এক্কেবারে ভেঙ্গে পরেছেন। আমায় জিজ্ঞেস করলেন ওর কথা। আমি আর কি বলব, নিজেই জানি না কিছু। কিছুক্ষণ থেকে চলে এলাম। তখন রাত্রদিন রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের টহল। কাউকে সন্দেহ হলেই তু্লে নিয়ে গিয়ে হয় বেদম মার, নেতা গোছের কাউকে হাতে পেলে তো কথাই নেই। পরে শুনেছিলাম ওদের দলের লিডার কে গড়েরমাঠে পালাতে দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে মেরেছিল।
একদিন মাঝরাতে পাগলের মতো অবস্থায় পেছনের দরজা দিয়ে আমাদের বাড়িতে এল। বলল, “দুদিন এখানে গা ঢাকা দিতে দিবি?” তিনদিনের মাথায় দুপুরবেলা পুলিশ এলো। “তুমি শিশির ঘোষালের বন্ধু?” “হ্যাঁ, কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?” “বন্ধু কোথায় গেছে খবর দাও নালে তোমার কপালেও দুঃখ আছে”। “আমি তো সত্যি জানি না। বেশ কয়েকমাস ধরেই ওকে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না। ওর মা বাবাও খুব চিন্তায় আছে”। কি করে অম্লানবদনে মিথ্যেগুলো বলতে পেরেছিলাম জানি না, তবে ওদের আমার কথা বিশ্বাস হওয়াতে আর কিছু প্রশ্ন করেনি। খবর পেলে যেন পুলিশে জানাই বলে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে চলে গেছিল। সেদিন রাতে বাবা মার কাছে বেশ কিছু কথা শুনতে হল। সে কথা হয়তো শিশিরের কানেও গেছিল। পরেরদিন সকালে উঠে আর ওকে খুঁজে পেলাম না।
তারপর একদিন খবর পেলাম শিশির ধরা পরেছে। চারদিনের মাথায় ওর বাবা গিয়ে পুলিশের বড়কর্তার হাতে পায়ে ধরে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ততদিনে ওকে মেরে মেরে আধমরা করে ফেলেছে। শুনেছিলাম ওকে নাকি উপরনিচে করে কড়িবর্গা থেকে ঝুলিয়ে বেদম মারত। কিছু হাড় তো ভেঙ্গেইছিল। তার সাথে শিরদাঁড়াও বেঁকে গেছিল”।
সেদিনকার পরে যেদিন পড়াতে এলেন সেদিন ওঁকে দেখে আমার চোখ ফেটে জল আসছিল। হয়তো সেদিনই যা বোঝার বুঝে ফেলেছিলেন। যা তীক্ষ্ণ চোখ, এদেরই কি বলে অন্তর্যামী? কে জানে, হবে বা! প্রথমদিনের মতো সেদিনও হালকা হেসে বলেছিলেন “চল, শুরু করা যাক”।
অঙ্কন – বুধাদিত্য
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন