রবিবার, ৭ মে, ২০১৭

দেওয়াল কথা (সম্বিত বসু)

দেওয়ালের কান আছে, মুখও। নইলে কানে শোনা কথা সে পাচার করে দেয় কীভাবে? দেওয়ালের জামা বিজ্ঞাপনের পাতলা কাগজ, সিনেমার পোস্টার। গা বেয়ে উঠতে থাকে সময়শামুক। কিন্তু তাছাড়াও দেওয়ালের চামড়ায় মিশে যায় রং। বিপ্লবের রং। রাজনীতির রং। দেওয়ালের চামড়ায় ফুটে উঠতে থাকে সময়ের ট্যাটু। সত্তরের নিষিদ্ধ বিপ্লবের সময়কে নিয়েই এই বই। বলা উচিত, সেই সময়ের দেওয়াল লিখনকে নিয়ে।  দেওয়াল লিখন নতুন কিছু নয় কিন্তু দেওয়াল লেখার আত্মকথা  নতুন। শুভেন্দু দাশগুপ্তর এই বইটি একইসঙ্গে তাঁর আত্মকথা অথবা আত্মকাহিনির মধ্যে ‘দেওয়াল লিখন’ অংশগুলোকে জুড়ে জুড়ে এই বই যা শেষপর্যন্ত কোনও দেওয়ালেরই আত্মকথা হতে পারত।
‘ভূমিকা’ অংশে শুভেন্দুবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, এই বই প্রস্তুতি হয়েছে মাথায়। মাঝে মাঝে লিখে রাখা হয়েছিল ডায়েরিতে। আবার হারিয়ে গিয়েছিল ডায়েরি। খুঁজে পেয়ে আবার কিছু লিখে রাখা। তা সত্ত্বেও এই বইকে খাপছাড়া লাগে না কোথাও। পাতাগুলোই অনেকাংশে কালো অক্ষরে লেখা দেওয়াল হয়ে যায়।
সব লেখা দেওয়ালে লিখে রাখা যেত না। আপত্তিজনক কিছু হলেই—পছন্দের লেখা না হলে পাটের গোছার জাবদা ব্রাশ দিয়ে লোক লাগিয়ে পুলিশ লেখা  মুছিয়ে দিত। লেখার ওপর পোঁচ-পোঁচ শাদা রং চাপিয়ে দিত, এবড়োখেবড়ো।  
দেওয়াল লেখায় নানারকম রঙই ব্যবহার করা হতো। কিন্তু নকশালের সময় নানা রঙের ব্যবহার কমে এসেছিল। শুধু লাল আর কালো। লেখক জানাচ্ছেন ‘অন্য রঙে কথা নরম হয়ে যায়। বিপ্লবের রং লাল। কঠিন কথার রং কালো।’ যারা নকশাল আন্দোলন কিংবা সত্তরের ভয়াবহ সময়ের মধ্যে যাননি, তাঁরা হয়তো এই বই ছুঁলে ছুঁতে পারবেন সেই দেওয়াল। যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় না কখনোই। যে দেওয়াল বিপ্লবের মধ্যে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই।

১৪ নং পাতায় একটি ফুলস্কেপ ছবি দু-পাতা জুড়ে। প্রথমবার দেখে দুম করে কেউ উল্টে যেতে পারবেন না। ছবির তো এমনই ক্ষমতা। কিন্তু বাকি সব ছবির থেকে এ-ছবি আলাদা, কারণ এই ছবি দেওয়ালের চোখ দিয়ে আঁকা। ‘এক হও’ শব্দটি মিরর ইমেজে রয়েছে ছবিতে। আর একজন শিল্পী, লিখছেন তুলি দিয়ে। অনেকদিন আগে লেখককে আর্ট কলেজের এক দাদা পরামর্শ দিয়েছিল এইরকম—
এমনভাবেই লিখবি যাতে মানুষ নিজে থেকেই পড়ে, পড়তে আসে। মাথায় ঢুকল তো? এটাই ফান্ডামেন্টাল। দেওয়াল লেখাটাই পলিটিকস। কী লিখবি যেমন পলিটিকস, কীভাবে লিখবি, সেটাও পলিটিকস। দেখানোটাও পলিটিকস।’

দেওয়াল লেখার আত্মকথা পড়তে পড়তে খুবই মনে পড়ে বান্স্কি-র এক্সিট থ্রু দ্যা গিফট শপ ডকুমেন্টারির কথা। ডকুমেন্টারির পাশাপাশি এই বই পড়তে পাঠকের ভালোই লাগবে আশা করা যায়। মনে পড়তে পারে, ভৈকম মহম্মদ বশীরের ‘দেয়াল‘ গল্পটিও, যেখানে দেওয়াল বলে আদৌ আর কিছু থাকছে না দুজন মানুষের মধ্যে। উবে যাচ্ছে। আর এই বইয়ে দেওয়াল যেন এক স্মৃতিফলক ।

অক্ষরের রাজনীতিও লুকিয়ে আছে এই বইতে। কারণ প্রস্তুতি নেই, এমন অবস্থায়ও লিখতে হয়েছে দেওয়ালে। কারণ সরকার-বিরুদ্ধ কথা বলতে গিয়ে হাতের লেখা এঁকেবেঁকে যায়। ওদিকে সরকারের দেওয়াল লিখনগুলো যথেষ্ট সময় নিয়ে, সুন্দরভাবে আঁকা। দেওয়াল লেখার বিপত্তি যে শুধু পুলিশে ছিল তা নয়। তখনও ঈশ্বর গুপ্তর প্রবাদবাক্যটি ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকেতায় আছি’-ই ছিল পরম সত্য। সেই মশার কথা এখানে না উল্লেখ করে পারলাম না—এদের জায়গা পা-এলাকা, পায়ের পাতা, আঙুল, গোড়ালির ওপর, হাঁটু অব্দি, ফুলপ্যান্ট থাকলে অনেকটা এলাকা কামড়মুক্ত। পাজামা, লুঙ্গি থাকলে লড়াই অসম। বসলে টের পাওয়া যায় না। যখন কামড়াত লাফিয়ে উঠতে হত। তুলির টান এদিক-ওদিক। মুছে-টুছে ঠিকঠাক করা সাংঘাতিক কঠিন।
 মশা-ই নয়, বাধ সাধত বৃষ্টিও। সদ্য করা রং, পুরোটাই ধুয়ে গেল। তার কষ্টও কম নয়। লেখকের কথাই বলে গেলে শুধু, এ বইয়ের প্রতি অবিচার করা হবে, কারণ এই বইয়ের অলংকরণও অসামান্য। যদিও শিল্পী তাঁর সংস্থার শর্তমাফিক নিজের নাম জানাতে চাননি। কিন্তু সুধী পাঠক, একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন এই তুলির টান আমাদের অতিপরিচিত। মনফকিরা খুব যত্ন নিয়ে ছেপেছেন এই বই। তাঁদের সাধুবাদ জানাই এই দেওয়াল লেখার শেষে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন