রবিবার, ৭ মে, ২০১৭

আশ্রয় (টিনা)



।। এক ।।
আজ বছর ৩ হলো মালতির ঠাঁই হয়েছে এই নিরালায়। আজও মনে পরে সেই দিনগুলো , বিয়ে হবার পর থেকেই কাঁকুড়গাছির শ্বশুরের ভিটেতেই তার দিনগুলো কেটেছিল স্বামী,শ্বশুর,শাশুড়ি,ননদ,দেবর নিয়ে । তারপর আসে রক্তিম, সবার আদরের বাবাই। কালক্রমে একে একে বিদায় নেয় সবাই । ননদ চলে যায় শ্বশুরবাড়ি,দেবর বিদেশে।বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ি প্রয়াত হন । অমলও বিদায় নেয়  মালতিকে একা রেখে । নিজের বয়সের যথার্থতা প্রমান করতে , আর মা এর একাকিত্ব কাটানোর সঙ্গী পাওয়া যাবে ভেবে রক্তিম বিয়েতে মত দেয় । বাড়িতে আসে সম্পূর্ণা, রূপে, গুনে অনন্যা । সেদিন মালতির চোখে ছিল আনন্দের  জল আর বুক ভরা স্বস্তির নিঃশ্বাস।শ্বশুরের ভিটের কার্নিশ গুলো ভাঙতে শুরু করে ।ফাটল দেখা দেয় দেওয়াল গুলোয় । বর্ষাকালে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে । সম্পূর্ণা ও রক্তিম দুজনই এখন আই.টি সেক্টরে কর্মরত । বাড়ির দিকে চোখ রাখার সময় তাদের নেই । কিন্তু মনে আছে অসহিষ্ণুতা । তাদের নিজস্ব মানটা ঠিক ভাবে বজায় রাখা হচ্ছে না । তাদের মনের মধ্যে আপ্রাণ একটি চেষ্টা চলছে , নতুন আশ্রয় খোঁজার ।বছর ২ ঘুরতে না ঘুরতেই সম্পূর্ণা আর রক্তিম এর জীবনে আসে আঁখি, তাদের একমাত্র মেয়ে । আর তার সাথে আশ্রয়ের তাগিদটা জোরদার হয়ে ওঠে ।উপায়ও সহজ, পৈতৃক ভিটেকে জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মসুখ চরিতার্থ করা ।এক বছরেই রক্তিম আর সম্পূর্ণার তাগিদ পরিপূর্ণতা লাভ  করল । নিউটাউন এর বিলাসবহুল দুই কামরার ফ্ল্যাট , খোলা বারান্দা , ৬০ লক্ষ টাকা মাত্র। বাপের ভিটে বিক্রি করে রক্তিম, সম্পূর্ণা আর আঁখি গিয়ে উঠলো নতুন ঠিকানায় ,মালতির  আশ্রয় এখন নিরালা।


।। দুই ।।
আখিঁর আজ সকাল থেকেই খুব মন খারাপ । আজ স্কুল ছুটি।আজ তো কালীপূজো,আলোর উৎসব। সকাল বেলায় মাম্মি পাপা যখন চলে যাচ্ছিল, অনেক বায়না করেছিল সে , যাতে তারা আজ তাকে একা ছেড়ে না যায় । কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনেনি । রোজকার মতই তারা আঁখিকে রুপার কাছে রেখে চলে যায় । রুপা,আঁখির আয়া, আঁখির অত্যন্ত  কাছের রুপা মাসি। তার সারাদিনের সঙ্গী।কিন্তু আজ তো রুপা মাসিরও ছুটি । তার বাড়িতে নাকি আজ কালীপূজো। রুপা মাসি তার ছেলে,মেয়ে,নাতি, নাতনির সাথে আজকের দিনটা আনন্দ করে কাটাবে। আঁখির মনটা ডুকরে ওঠে, খুব কান্না পায় তার  । উৎসবের দিনেও মাম্মি পাপার সময় হয়ে ওঠেনা তার সাথে একটু আনন্দ করার, তার সাথে সময় কাটানোর ।  পাপার কাছে শোনা, পাপা যখন ছোট ছিল দাদু,ঠাকুমা অনেক আতসবাজি কিনে আনতো , আর  পাপা,দাদু ঠাকুমার সাথে সেসব নিয়ে খুব আনন্দ করত । অনেক মজা করতো সবাই। আঁখির তো কেউ নেই, সে যে আজ বড়ো একা। এই ভেবে কাঁদতে কাঁদতে সে ঘুমিয়ে পড়ে ।

।। তিন ।।
রক্তিমের কিছুতেই কাজে মন  বসছে না । একে তো শনিবার , তার উপর কালীপূজো। গত বছর কালীপূজোর দিন ছুটি ছিল । এই বছরই কিরকম যেন সব ওলোটপালোট হয়ে গেল ।আঁখির কান্না ভরা মুখটা সারাদিন খুব মনে পড়ছে । ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে , আর তার আবদার গুলো মেটাতে পারছে না, বাবা হিসাবে নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে রক্তিমের । নিজের ছোটবেলাটা মনে পড়ে যাচ্ছে । বাবা মা-র কাছে কোনো কিছু আবদার করা মাত্রই  সে সেটা পেয়ে যেত । স্বল্প আয়ের সংসারে ,সব কিছু সামলেও তার বাবা তার কোনো কিছুর অভাব বোধ হতে দেয়নি । নিজের জন্য পূজোতে নতুন জামাকাপড় না কিনেও, ছেলের সব বায়নাক্কা মিটিয়েছে , আর দিয়েছে অফুরন্ত সময় । সেই সময়টা কে সদ্ব্যবহার করে শুনেছে তার সমস্ত ইচ্ছে , আর পূরণ করেছে যথাসাধ্য ।ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ৬.৩০ টা বেজে গেছে খেয়ালই  করেনি রক্তিম । সম্পুর্নাকে স্কাইপে  পিং করে বেরোতে বলল। আজ তারা একসাথে বাড়ি ফিরবে ।

।। চার ।।
সারাদিন এর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রক্তিম আর সম্পুর্না যখন তাদের ফ্লাটে প্রবেশ করল, দেখল আঁখি সোফাতে ঘুমাচ্ছে । আলতো করে একটি সুইচে চাপ দিলো রক্তিম, পুরো ঘর আর বারান্দাটা টুনিলাইটের আলোয় ভরে উঠলো । আঁখির ঘুম ভেঙে গেলো । ঘুম  থেকে উঠে এতো আলো দেখে সে অবাক । চুপচাপ বসে রইলো সে । ঠিক সেই সময়ই নিরালার বারান্দাতে সবকটা প্রদীপের সলতেতে একসাথে আগুন জ্বালানো হল । চার বছর বয়সী আর পঁচাত্তর বছর বয়সী দুই নারীর চোখের জলে সেই আলোর ঝিকিমিকি খুব স্পষ্ট, অভিমানী ও একান্ত ব্যক্তিগত ।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন