রবিবার, ৭ মে, ২০১৭

ডিরেলিয়াম (অভিজিৎ দে)

#
অফিস ফেরত পায়ে পায়ে আজ চলে যাই ময়দানের দিকে | শীত বিকেলের অন্ধকার নেমে আসে ঝুপ করে| লোকজন মেলে ধরা সম্পর্ক গুটিয়ে বগলদাবায় ফিরতি পথ ধরে | যাঁরা তখনো বাড়ি ফেরার ইচ্ছে পকেটে রেখেছে তাঁদের একে একে উঠিয়ে দেয় পুলিশ |ঝিম ধরা সোলার আলোয় কিছু গুমটি দোকান নিজেদের অস্তিত্বর চিহ্ন রেখে দিয়েছে তখনো | নিরুপায় ফাঁকা ময়দানের চাপা কষ্ট হয়তো মিশে আছে ধুলোর ঘাসে কিংবা ছেড়া কাগজে , প্লাস্টিকে | রাস্তার পাশ বরাবর একটা গাছের কোল চেপে দাঁড়াই আর এসব হিজিবিজি দেখতে থাকি| আমার হাতের ফাঁকে আটকে থাকা আগুন সিগারেটের লালটা ছন্দময়ভাবে বাড়ে আর কমে | পাশ থেকে এক মহিলাকন্ঠ কী যেন বলে যায়, সম্ভবত ওর সাথে বসার কথা| উত্তর করি না | নেমে আসা সন্ধের এই সময়ে ফ্লায়িং বডিল্যাংগুয়েজের মহিলাদের আগেও দেখেছি।

 -এখানে বসলে কোনো অসুবিধা নেই দাদা|

জানিনা কেন আমি যন্ত্রচালিতের মতো রাস্তার ধারের বেঞ্চটায় ওর পাশে গিয়ে বসি|
অন্ধকারে ডোবানো মহিলার মুখ আমি দেখতে পাই না |
মহিলা বলে ওর ডান দিকটা অনেকটা পোড়া ও লাইনের নয় , শোয় না কারো সাথে | মিনিট দশেক মতো বসি , ওর হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে উঠে আসি রাস্তার দিকে | মহিলা হয়তো আবার চলে যায় অন্য কাউকে বাসার জন্য বলতে |
কিংবা ফিরে যায় বাড়িতে | ছেলে ,মেয়ে বা অসুস্থ  স্বামীর কাছে...অবশ্য এসবের কিছু নাও হতে পারে অন্য কিছুও হতে পারে | আমাদের মতো মানুষের কল্পনা অনুমান কতই বা গভীর হতে পারে |
রাস্তা টপকে ফুটপাথ হেঁটে সোজা একাডেমির মুক্তমঞ্চটার কাছে আসি | একটা অন্ধ মানুষকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে এক মেয়ে, একদল ছেলেমেয়ে গিটার নিয়ে গান গাইছে , প্রেমিক প্রেমিকা হাতে হাত উষ্ণতা মেপে নিচ্ছে রিস্তার, অনেক মানুষের হাসি কান্না সুখ দুঃখ কথা মিশে যাচ্ছে একসাথে | এইসব গল্প টুকরোই তো জোড়া লাগিয়ে আঁকতে চেয়েছি জীবনের এমব্রয়ডারি কিন্তু পারছি কই , সব কিছ মুখ থুবড়ে পড়ছে শহরের রাস্তায় আর পিষে যাচ্ছে গতিময় যানগুলোর দানবীয় চাকায় |স্প্রে করা জ্যোৎস্না আলোয় কালো চশমা চাপিয়েও গাড়িগুলোর চাকায় লাগা লাল ছাপ আমি দেখেতে পাচ্ছি স্পষ্ট |

এখন আর আগের মত অসুখ নেই | তোমাকে খুব ভালবাসতে , আদরে মেশাতে ইচ্ছে করে | তবে তার আগে খুব ইচ্ছে করে তোমাকে ঢেকে ফেলি শব চাদরে , দেহ উষ্ণতা নামাই বরফে , আর শিথিলতা পৌঁছে দি পরমে | ভেঙ্গে যাওয়া ঘুম জোড়া লাগাতে পারি না তাই তোমারও ঘুম ভাঙাই | এসব কথা সবটাই তোমাকে বলি | তুমি চুপ করে শোনো নেক্রোমানুষী গল্পকথা | তারপর চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে চলে যাও অন্যঘরে | বন্ধ করে দাও দরজা | আর কি করো বা ভাবো কোনোটাই আমি জানতে ও বুঝতে পারি না | আমি জানি এরপর থেকে কোনোদিন হয়তো আমরা পাশাপাশি এক বিছানায় কাটাবো না | ওই দরজাও কি কোন দিন তুমি খুলবে রাতের বেলায় ?

#
নেশাতুর চোখ নিয়ে পানশালা থেকে বেরিয়ে আসি , মায়াবী নিয়নে ঝলসে যাচ্ছে একটা পার্কস্ট্রীটীয় রাত | হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এসে বাসস্টপে দাঁড়ায় | মিনিট খানেক বাদে বালিগঞ্জগামী মিনি এসে থামে | আমি ঢুকে যায় বাসের পেটের ভিতর | শহরের শরীরের পিচকালো শিরা বেয়ে ভীষণ দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছয় বাস | এর কিছু আগেই শেষ ট্রেন চলে গেছে স্টেশন ছুঁয়ে| এই রাত বারোটায় ট্যাক্সি পাবার আশা নেই কোনো |কেতা দস্তুর ওলা উবেরের সীমা আমার বাড়ির অনেক আগেই ফুরিয়ে যায় | অগত্যা রাত কাটাতে স্টেশনের একটা সিট বেছে নি |আলো ক্রমে কমে এসেছে তখন | আবছায়া আলোতে আমি দেখি স্টেশনে দিন কাটানো মানুষরা কিভাবে ঘুম ভাগ করে নিচ্ছে | উল্টো প্লাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনের শেষ প্রান্তে দুজন মানুষ বেঁধে দেয় বাঁশ আর পস্টিক |আমি জানি এ জিনিষ রেলে কাটা লাশ তোলার জন্য বাঁধা |এরপর তারাও ভাগাভাগি করবে ওদের ঘুম ,নেশা | আমার কোনো কিছুই কারো সাথে ভাগ করার নেই এখন | তন্দ্রাছন্ন চোখে লাল আলোর ঘড়ির সময় বদল দেখি আর অপেক্ষা করি কারশেড থেকে ঘুম ভেঙে ছুটে আসা প্রথম ট্রেনের | প্রথম ট্রেনের অপেখ্যা করে আছে ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক শরীর তাঁর গন্তব্যের জন্য | আরো অনেকেই অপেক্ষায় থাকে প্রথম ট্রেনের তাদের কোনো কথাই আমি জানি না | জানার প্রয়োজনও কী বোধ করেছি কখনো ?

#“চুমুরছাপ রং নিয়ে যেন উড়ে যায় পর্তুগালে
    ভালোবেসে অনেকেই তো আবির মাখায় গালে।।“

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন