রবিবার, ৭ মে, ২০১৭

চিঠি (অর্ঘ ব্যানার্জী)


মৈত্রেয়ী,

আজ সকালেই তোর চিঠি পাই.. অফিস এ নিজের ছয় বাই ছয় খোপে বসেই পড়লাম পুরোটা.. লাঞ্চ টাইম এ.. জানিনা কি বলবো তোকে...হয়ত এটাই কারণ যে তোকে দীর্ঘদিন কোনো চিঠি পাঠাইনি। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারিনা মৈত্রেয়ী । শেখাসনি । এবারে তো আরোই ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা... এও জানিনা আমাদের দ্রুত বদলে যাওয়া শহরটাকে ফিরে গিয়ে যখন দেখবো তখন নিজের বলে  ভাবতে পারব কিনা!!এই কয়েক দিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে তোর-আমার কলকাতায়... তোর কাছে আমার আগের চিঠিটা পৌঁছনোর কয়েকদিন বাদেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের  vice chancellor এর নিমন্ত্রণ পেয়ে ক্যাম্পাসে এসে, ছাত্র পিটিয়ে ফিরে গেছে সরকার এবং পুলিশ..
এই তো সেইদিন সবাই বিশাল মিছিল বার করলো গোটা শহরে ; আনোয়ারশাহ  , ঢাকুরিয়া ব্রিজ জুড়ে। সে কত লোক!!এতজন বাঙালিকে একসাথে একটাই স্লোগান উচ্চারণ করতে দেখলে সত্যিই ভালো লাগে বড় | মিছিল এ গোটা শহর এর মানুষ পা মেলালো, 'কলরব' করল ,ফটোগ্রাফার-রা পটাপট ছবি তুলল, গাইয়েরা গান লিখল; তারও দুদিন বাদে যেই মেয়েটিকে নিয়ে এতো শোরগোল, সে নিজেই এসে পাল্টা বিরোধী মিছিল এ  হেটে এলো, সে খবর ও পেলাম.. তার কয়েকদিন বাদেই দূর্গা পুজো গেলো.. অনেক বছর বাদে একটা বৃষ্টি-তে-মাটি-না-হওয়া  পুজো । তারপর লাইন দিয়ে কালী পুজো, ভাইফোঁটা.. তার আসে পাশ দিয়ে এক এক করে এতো বছর এর চেপে রাখা রাজনৈতিক কেচ্ছা কেলেঙ্কারি সব বেরিয়ে আসা!! বর্ধমান এর মতো একটা সুন্দর জায়গা কে বিষিয়ে দিলো ওরা, খবর পেলাম...ভয় হয় জানিস। আতঙ্কে থাকি কোনদিন না আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় আমার কাছের মানুষগুলোর অসহায় মুখ দেখতে পাই!!

এক এক সময় এমন লাগে, মৈত্রেয়ী, যেন বিশাল উঁচু বিল্ডিং এর শেষ কিনারে  দাঁড়িয়ে আছি ।কাঁচ দিয়ে ঘেরা. আর বাইরে, অনেক নিচে, আমার কলকাতাটা জ্বলছে,আগুন এর শিখা অনেক ওপর অবধি উঠে আসছে..
পিঁপড়ের মতন  ছোট ছোট মানুষ গুলো দৌড়োচ্ছে,
 বাস ভাঙচুর করছে, অল্প দূরে তরুণীরা ধর্ষিতা হচ্ছে(সব সাজানো ঘটনা কিনা জানিনা), পুলিশ এর যেখানে কাজ করার দরকার, সেখানে নীরবে দাঁড়িয়ে;যেখানে নাক গলানোর মানে নেই সেখানে  গিয়ে মারধর, গ্রেফতার। মাঝখানে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে মেয়ে প্রতিবাদ এর গান লিখছে, গাইছে, ছবি করছে ।তারা চাইছে তাদের বক্তব্য সবাই শুনুক । তাই এরা অমুক পারে(মাচা-স্বল্পমূল্যে), অমুক jam event এ(non মাচা-বিনামূল্যে) গান গাইছে এবং পরের দিনে facebook এ dp দিচ্ছে... কিন্তু যারা প্রাণ হাতে নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, মৈত্রেয়ী, তারা এসবে কান দিচ্ছেনা.. তারা এসব ধামা ধরায়  যায়না । তারা বরং দেখছে যে এরা কোন ইভেন্ট এ কি কি pose এ গান গেয়ে এসেছে, বা facebook এ কোন মেয়েটা নতুন photoshoot করিয়ে dp দিয়েছে! নতুন গান শুনতে গেলে বা একটা short film দেখতে গেলে অনেক ভাবতে হবে, অত ভাবনা কে ভাববে!! ফলে বাংলার ঘরে ঘরে এখন প্রচুর "শখের" photographer... তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব watermark আছে! সৌম্যর সেই যে বন্ধু টা আছে না, যে তোদের গ্যাংটক এর ছবি গুলো আপলোড করে তলায় নিজের নাম লিখে দিয়েছে, সেও নাম লিখিয়েছে এদের দলে ।
অদ্ভুত একটা সমীকরণ তৈরি করছে ব্যাপারগুলো মৈত্রেয়ী।  ছোটবেলায় অবাক হতাম, বয়েস এর সাথে সাথে ভয় বাড়ছে;  কারণ ছোটবেলাটা  হারিয়ে যাচ্ছে । পুরোনো জগৎটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারছিনা বলেই হয়তো আরো অসহায় লাগছে ।
বড্ডো বেশি ভেবে ফেললাম বোধহয়ে না রে? আমার কাঁচের দেয়াল এর বাইরে দিয়ে অত কিছুও  দেখা যায়না খালি চোখে , চোখ বুঝলে যায় হয়তো...
তবে যেটা দেখা যায়, এতো দাঙ্গা হাঙ্গামার মধ্যেও আমাদের শহরটা নিশ্বাস নিচ্ছে । আমার এই  কাঁচের  বাক্সটার মধ্যে তো প্রাণ এর খুব অভাব বোধ করি; এই ঘটনা গুলোই কি প্রমাণ করে যে যেভাবেই হোক, কলকাতা আজও লালনে বিশ্বাস করে?
সেই জন্যেই কি এতো ঘটনার পরেও লোকে নতুন করে আপোষ করে নেয়? সেই কারণেই কি KIFF এলে বাঙালি লম্বা লম্বা লাইন দেয়, ছুটে ছুটে যায় সিনেমার টানে, বা ভীড় করে নাট্য উৎসব এ, বা মেতে ওঠে বড়দিনের আলোয় ?এই ভাললাগা গুলোই কি শহরটা কে তিলোত্তমা করে তুলেছে?
বল না, আমার চরিত্রের মধ্যে যেই জিনিস টা তোর স্মৃতি গুলোকে তাড়া করে বেরায়, সেটার জন্যেই কি আমাকে এখনো মনে ধরে রেখে দিয়েছিস তুই? সেটার
আমাকে এখনো মনে ধরে রেখে দিয়েছিস তুই? সেটার
জন্যই কি আজও ভুলতে পারিসনা?
P.S: বেশ চটপট একটা উত্তর আশা করছি এবার .. ভালো থাকিস….

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন