
কথাটা খুলেই বলি। আমাকে দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি বেশ অসুস্থ। মানে যাকে বলে, কবরের উপর এক পা দিয়ে আছি। অফিস যাচ্ছি না দুমাস হল। এখন সকালবেলা জম্পেশ ব্রেকফাস্ট সেরে ছাদের ঘরটায় শুয়ে থাকি। শুয়ে শুয়ে বউয়ের সংসার আগলানোর বিভিন্ন শব্দ শুনি। এই বাসনকোসনের ঝনঝন তো ঐ ঝিকে হুকুম দিচ্ছে। আবার কখনও আঁচলে চাবি ঘুরিয়ে ডালে রসুনের ফোড়ন দিচ্ছে।
এদিকে দুপুরে লোডশেডিং। মুহুর্তে বিছানা ঘামে ভিজে গেল। দুবার এপাশ ওপাশ করতেই দেখি, সে কথা সটান এসে আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। কিছু বলবার আগেই আবার হাতপাখাতে বাতাস তুলেছে। তাই, যা বলছিলুম, আজকাল বউকে দেখে আর কাম চিন্তা মাথায় আসে না।
তবে, আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, আমার বন্ধুরা কত কামপ্রবণ। ওরা ঘরে এলে ওদের ওপর থেকে নজর সরাই না। গোপনে লক্ষ্য রাখি ওরা কিভাবে আমার বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে। বউ হাঁটলে কোথায় কোথায় চোখ রাখছে। চায়ের কাপ নেবার সময় হাতে হাত ঠেকালো নাকি! ইয়ার্কির ছলে কোন ইশারা দিচ্ছে না তো! কিন্তু বউও তেমন। কিছুতেই আমাকে অটোর সামনের সিটে বসতে দেবে না। বলবে, তুমি না অসুস্থ। আমি ভেড়ার মত পেছনে সেঁধিয়ে যাই। আর দেখি সে ড্রাইভারের ডান দিকে বসে ঠিক টারজানের মত তারাতলা ছুটছে।
তো, এই হল, মোটামুটি আমার আর আমার বউয়ের গল্প। কিন্তু এটাকে কি আর সত্যিকারের গল্প বলা যায়, বলুন? বড় বড় সাহিত্যিকদের ছোট গল্পেও কী সুন্দর ভাবে মহৎ আকাঙ্ক্ষা গুলো পরতে পরতে বোনা থাকে। সে সব গল্পের প্রতিটা শব্দ, বাক্য, প্যারাগ্রাফ আমাদের মধ্যেকার যা কিছু মহৎ, যা কিছু চিরন্তন, যা কিছু মানুষের অস্তিত্বের জন্য উল্লেখযোগ্য – সেইসব কিছুর দিকে ইশারা পাঠায়। মহৎ লেখকদের মহৎ গল্পগুলো তাই আসলে এক একটি সংকেত। ওনাদের লেখা সংকেতময়।
কিন্তু আমার আর বউয়ের মধ্যে সংকেত তো দূরে থাক; ইশারাও নেই।
বসন্তের সন্ধেবেলা। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। আমার এ হেন রোগা শরীরও সাড়া দিচ্ছে তাতে। অথচ সেই স্থূলদেহ সাবধানে ছাদের ঘরে উঠে আসে না একবারও।
আমাদের মধ্যে যা কিছু – তা কেবল – বেঁচে থাকা। বাজার করা, খাওয়া, ইনকাম বাড়ানো, সিরিয়াল দেখা আর বেঁচে থাকা।
কিন্তু এইসব দিয়ে তো আর গল্প হয় না। তাই আমি চাইছিলুম, আমার এই গল্পটার সঙ্গে যেন কোন মহৎ পেইন্টিং বা ফটোগ্রাফ ছাপানো হয়। এই যেমন – রঘু রাইয়ের কিছু স্টিল বা যামিনী রায়ের আঁকা কিংবা খুব ভাল হত যদি ‘পথের পাঁচালি’র কোন দৃশ্য কোন ভাবে দেখানো সম্ভব হত। এই যেমন, অপু সর্বজয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সর্বজয়ার চোখ ছলছল করছে। তবু চোখের পাতা পড়ছে না। সেই চাউনি যেন কত যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা কত যুদ্ধ, কত অসম লড়াই, কত বিপ্লবের সাক্ষী। এই চাউনি চিরন্তন। এই চাউনিকে কেউ টলাতে পারবে না।
কিন্তু আমার বউয়ের চাউনি মোটেই এমন নয়। সে কত অনায়াসে ইঁদুরকে বিষ দিয়ে, আমাকে ভিটামিন খাইয়ে এক বোতল পানি মাথার পাশে রেখে ঘুমোয়।
তখন আমার বউকে ঠিক মায়ের মতই মনে হয়।
অঙ্কন – সৌরভ চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন