সোমবার, ৮ মে, ২০১৭
ইতি উতি কথা
ডিগবাজি (সৌমী ভট্টাচার্য্য)
ঘুমটা ভাঙলো ভোর পাঁচটার একটু আগে। জলটল খেয়ে ঘরের লাগোয়া বারান্দাটায় একটু পাইচারি করে আবার শুতে এসে দেখি বিছানার ওপর পাশের বালিশটাকে জড়িয়ে দিব্যি বসে আছে একটা মোটাসোটা লাল রঙের বেড়াল। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এলো, "চন্দ্রবিন্দু!
বেড়াল এবার খুব বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়তে নাড়তে পরিস্কার বাংলায় বলে উঠলো, "হলো না! হলো না!" আমার একটু বিরক্তই লাগলো, "বললেই হলো চন্দ্রবিন্দু নয়! দিব্যি ল্যাজ থাবা নিয়ে হযবরল-র পাতা থেকে উঠে এসেছো।"
বেড়াল উত্তরে কিছু বললো না। বরং ল্যাজটা পিঠের ওপর ফুলিয়ে তুলে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। এবার আমার ভারি রাগ হলো। সুর চড়িয়ে বললাম, "শুধু উঠেই যে এসেছো তা তো নয়! এই মাঝরাত্তিরে আমার কল্পনার সু্যোগ নিয়ে আমারই বিছানা জুড়ে বসে আছো। আচ্ছা চন্দ্রবিন্দুই যদি না হও তাহলে কে বলোতো তুমি?"
বেড়াল এবার গম্ভীর হলো। পাশের বালিশটাকে ছেড়ে সামান্য আড়মোড়া ভেঙে খাটের কোণে গিয়ে বসলো। তারপর খুব অন্যমনস্ক ভাবে বললো, "আমি ঌ কার। তবে চন্দ্রবিন্দু যে একেবারে নই সে কথাও ঠিক নয়।"
বোধগম্য হলো না। মরিয়া হয়ে বললাম, "তুমি তাহলে লিকার! মানে দুধ ছাড়া যেমন পানশে চা!"
"আরে, ধুর মশাই! ঌ কার - ঌ কার! স্বরবর্ণের পঞ্চম বর্ণ যা বাদ পরে গেছে তোমাদের দুনিয়া থেকে, মাঝেসাঝে বেঁকা হরফে যাকেই আবার কিনা ফিরিয়ে আনতে হয় গোঁজামিল দিতে সেই ঌ কার।"
"বুঝলাম!" একটু ধাতস্থ হয়ে বললাম, "তাহলে তুমি ঌ কার-ই হবে নিশ্চিত, চন্দ্রবিন্দু কভি নেহি।" এভাবে ভুল নামে ডাকার জন্য একটু একটু খারাপই লাগছিলো।
ঌ কার দরজার দিকে এগোতে এগোতে বসে পড়লো। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো, "আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেলো দেখছি! বলোতো, কাল যে রতন পাকরাশির মুখ ভর্তি চাপদাড়ি ছিলো, আজও আছে? তারপর ধরো, একটা দেশ ছিলো। একটা পাঁচিল তুললে কি তুললে না হয়ে গেলো দুটো ভূগোল বই। তা তোমার কথাই ধরো না!তোমার বিছানায় আগে তিনটে বালিশ থাকতো, এখন একটা মোটে, ছোঃ! যাদের দোকানে আগে পাওয়া যেতো চশমা আর পেনসিল, তাদের দোকানেই বিক্রি হচ্ছে লাঠি আর মানুষ।যে পাগলা খুড়ি আগে দোরে দোরে ভিক্ষে চাইতো, আজ সে অটোগ্রাফ বিলোচ্ছে।তার বেলা! আর আমার বেলাতেই দোষ! চাঁদের মাথায় মহাকাশযান গিজগিজ করছে,তাছাড়া উচ্চারণে তোমাদের এতোই যখন আপত্তি, তখন স্যুট করে নেমে এসে মিশেছি স্বরদের দলে। এলিডি ফেলিডি নয়, তোমাদের প্রয়োজনে চোখ খারাপ টিউবের মতো স্রেফ জ্বলছি আর নিভছি।" ঌ কার একটু থামলো। দম নেবার জন্যই বোধহয়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে চললো, "সেদিনের জন্যে আমি ছিলাম চন্দ্রবিন্দু আর আজকের জন্যে ঌ কার। তবে কিনা আগামীকালে যদি আবার আমার সামনে এসে পড়ো তাহলে আর শুধু ঌ কার বলেই ধরে নিও না। বুঝলে?" দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হলো সে।
তবে অনেক বিস্ময়ের শেষে এবার আমার ফুল্টস্ বলটায় টাঙিয়ে ছয় চালানোর পালা।
মুচকি হেসে বললাম, "সবই তো হলো। একটা জিনিষে যে ভুল হয়ে গেলো তোমার!" ঌ কার আবার দাঁড়িয়ে পড়লো।
"মানে, ঐ গুণতির ব্যাপারটা আর কি।" বুঝিয়ে বললাম, "তা হিসেব করে দ্যাখো, ঌ কার হলো গিয়ে স্বরবর্নের অষ্টম বর্ণ। পঞ্চম বললে কিভাবে?"
ঌ কার এবার মুখটা বিকৃত করে ভেংচি কেটে উত্তর দিলো, "রাখো তো তোমাদের হিসেব! যেদিক দিয়ে অ্যাদ্দিন ভেবে এসেছো তার বাইরেও যে কিছু দিক থেকে যায় সেটা ভেবেছো কি? পুরোটাই নির্ভর করছে তুমি কোন দিক দিয়ে গুণছো আর আদতেই অঙ্কটা মেলাতে চাইছো কিনা তার ওপর।"
বলেই সে দরজা দিয়ে বারান্দার রেলিং ডিঙিয়ে পগার পার। মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগলো কটা বর্ণ... হ য ব র ল ... ঔ ও ঐ এ ঌ!
অঙ্কন – বুধাদিত্য
বর্ষাভিসার (মিতুল দত্ত)
প্রণাম কোথায়,
আজও ঋতুস্নান শহরে শহরে
কাজল মেঘের বমি মেখে
শুয়ে আছে মধ্যরাত
কোথায় তোমার ডিঙা?
কোন মানসগঙ্গার তীরে
ভেসে আছে আমাদের বাসনার
ব্যগ্র কলহাঁস?
দোয়াত ভেঙেছে কার?
গলি আর বস্তির শিয়রে?
কত না সন্দেহে তুমি আপেল
ছিঁড়েছ সাদা দাঁতে
কোথাও ঝংকার হলে,
নূপুরে জড়ালে বিষধর
তোমার হাসির দাগ জড়ুলের মতো ফুটে ওঠে
সঘনগহন মেঘ,
ভুলে গেছ অশনিসংকেত?
শহরে শহরে আজও ভিজে মরে, প্রেমিকার প্রেত...এবার কিছু চন্দন হোক (অদিতি বসু রায়)
এবার কিছু চন্দন হোক
!
কথা হোক সকাল ও অরণ্যদেবের ।
ধনুক, বন্দুক - অনেক হল
অনেক হল ট্রয় , কুরুক্ষেত্র, হিটলার, চার্চিল !
গ্রীষ্মকালের গল্প আর ভাল লাগে না
ভাল লাগে না প্রহরীর লাল চোখ
মাস্তুলের বিকেলে
আমি ছবি আঁকা শিখি
এখন ।
পাথরের ক্ষয়িষ্ণু শব্দ (অরিত্র সান্যাল)
এই ভিড় বাবলা -তলার ভ্যান স্ট্যান্ডে,
একটা সরণময় পৃথিবীর শেষ |
কে হাঁকে - আসেন বাবু কবেকার রোদ্দুরে
যেতে চান, টইটুম্বুর আছে যৌবনে
শালুক ফুলের আঁশ, বিষাদের এমন সজল ঢেউ
ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের অনুতাপ মুড়ে পেতে তোলা হয়
আঁখিনোনতা তোমার পুতুল মুখ
তোমার হাসিতে পোড়া
মাটির শহরে তোমাকে ভাতের মতো মাখা
মনে পড়ে যাবে | এই এত সুখ স্বচ্ছলতা মাছের গন্ধে
তোমার ঘ্রাণের নোলক পড়ে আছে, দেখে যাও| তাতে
কে যে লাল রং দিলো...
এমন পটের গান শোনা যায় যাতে শৃঙ্গার রস মানে
সাপ | মরে পড়ে আছে | অথবা যেকোনো কিছুই
এই পৃথিবীর
পরে |
এটা কবিতা ? (শুভময় দে )
কখনও কিছু শব্দ বাদ দিয়ে
কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে |
ফুল, নদী , ঝর্ণা, পাহাড়
রক্ত, বিশ্বাস, ঘৃণা, হাহাকার
এসব বাদ দিয়ে |
যেমন ধরুন
বিকাশবাবু সাইকেলে যাচ্ছেন
গায়ে চাদর, মাথায় মাফলার
বেশ শীত পড়েছে | ভোরবেলা |
ট্রেন ধরবেন, অফিস যাবার |
অভ্যেসমতো পিছনে হাত দিলেন |
পকেটে | মানিব্যাগ নেই |
এবার ? ফিরবেন, না এগোবেন ?
চিন্তাটা ঘুরতে লাগলো |
মাথা, ঘাড়, পেট, কোমর
পা হয়ে প্যাডেলে |
ধাক্কা মারলেন রিক্সায় |
পড়ে গেলেন, এবং খিস্তি মারলেন |
এরপর, ধরে এককাপ চা খেলেন|
এবং, হেঁটে সাইকেল নিয়ে
বাড়ি ফিরলেন |
একে আপনারা কবিতা বলেন
কই, এতে তো
আনা ফ্র্যাঙ্কের গৃহবন্দীর কথা নেই |
আশ্টবিজে ট্রেনে করে মরতে আসা
ইহুদিদের কথা নেই |
রুট ৬৬ ধরে জমি বাড়ি বেচে ওকলাহামার
কৃষকদের ক্যালিফর্নিয়া যাবার বর্ণনা নেই |
কিংবা, দিদিমাদের কুপার্স ক্যাম্পে আসার
গল্পটাও নেই |
নেই | নেই | নেই |
সত্যই কোন কৃতজ্ঞতা নেই | কবিতার |
দখল (কৃশানু দাস )
কেউ বেয়োনেটে
কেউ ব্যক্তিত্বে
কেউ ছলনায়
কেউ ভালোবাসায় (কামনায়)
কেউ আদর্শে
দখলদার সবাই |
বাজার থেকে গাজার
কাশ্মীর থেকে তাওয়াং
ভিয়েতনাম নাকি নন্দীগ্রাম
mannerism থেকে nepotism
বেদখল হয়ে জবরদখল
মনুষত্বের জবাই |
টুকটুকে লাল জামা পরে সে শুয়ে আছে
ঢেউ খেলা করছে ওর বুকে
ফর্সা মুখটা ভেজানো আছে ক্ষমায়
৩ ফুট বাই ১ ফুট জায়গা 'দখল' করে শুয়ে আছে সে
সবাই কে দখল এর সংজ্ঞা শেখানো আলিয়ান
এবং দু- লাইনে (শ্রীমান অভিজিৎ )
##
গড়ে ওঠা হৃদয় সভ্যতা, ফিরে যাই নদীমাতৃক
ধ্বংসস্তূপে চাপা থাকা স্মৃতি ভোলে ইতিহাসের দিক!!
##কাকভিজছে
আমার শহর রংবসন্তের ইচ্ছেবারিশে,
জেব্রাক্রসিং
রঙ্গিন দেখাক তোর চুলের আবির মিশে !!
##আকর্ষণে চুম্বক লোহাকে কাছে আসতে শেখায়
একটা জলজ্যান্ত “আপনি” হটাৎ “তুই” হয়ে যায়...
##ইচ্ছে
করেই
কথার
পিঠে
বসিয়ে
দিচ্ছি
কথা,
ভুল করে ভাবতেই পারিস, এলিয়ে পড়া দুর্বলতা!!অনশ্বর (বুধাদিত্য গোস্বামী)
কিছু কিছু ভাবনা মুছে যেতে চায়না
স্মৃতি হয়ে থেকে যায় গভীরে
ঠিক যেমনটা ব্যথা মরে গেলেও
ক্ষতচিহ্ন রয়ে যায় শরীরে |
মনের চিলেকোঠায় জায়গা করে নিয়ে
কিছু মুখ থাকে এক কোণে
যত চাও বার করে দিতে একেবারে
রঙছুট তবু তারা থেকে যায় মনে |
স্মৃতি হয়ে থেকে যায় গভীরে
ঠিক যেমনটা ব্যথা মরে গেলেও
ক্ষতচিহ্ন রয়ে যায় শরীরে |
মনের চিলেকোঠায় জায়গা করে নিয়ে
কিছু মুখ থাকে এক কোণে
যত চাও বার করে দিতে একেবারে
রঙছুট তবু তারা থেকে যায় মনে |
তোমার ভাবনা সম্পর্কিত দু-চার কথা (ত্রয়ী দাস)
একটা ঘর আর ঘর এবং ঘরের মধ্যিখানে একটা বিষাদবায়ু কুন্ডলী পাকায়, যেরকম তোমার এক পা
সমুদ্রবালির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অন্য পাকে আঁকড়ে ধরতে চায়,
সেরকম একটা হারিয়ে যাওয়া দিনে তুমি ঠিক জানো?
তোমার কি একবারও মনে পড়বে না চিলেকোঠার ছেলেবেলা?
মনে পড়বে না নিষিদ্ধকে পেতে গিয়ে অনেক ভয়ও তোমাকে পেয়েছে?
আগ্রার মতো শহরে তুমি গেছ শ্রাবণ মাসে, দেখেছ কিভাবে সব বয়সজাত পুরুষ-নারীরা প্রেমে ওঠে নামে।
তোমার ভিতরও ক্রমাগত বেড়ে উঠেছে লতা পাতা গুল্মর মতো ধমনীতে রক্তের উচ্ছ্বলতা,
এইসবই তো বাড়ে প্রতিনিয়ত।
অথচ তুমি তো পাখি হতে চেয়েছিলে, যেমন অমলকান্তি রোদ্দুর ।
তুমি তো রোদে হেলান দিয়ে তোমার পরিপাটি মা-কে খুঁজেছিলে,
অথবা মায়ের মতো কাউকে ।
এই যে সকালে তুমি অনিশ্চিত চায়ের কাপে চুমুক দাও, এই ভোরবেলা যেটা তুমি যাপন করো,
তারপর ভোর উত্তীর্ণ বেলায় পড়ে নাও বল্কল ছেড়ে বর্ম, ঋষি থেকে তোমার উত্তরণ ঘটে সৈনিকের...
আর দূরে কোথাও বসে থাকে প্রেমিক মানুষ।
সমুদ্রবালির মধ্যে ডুবে যেতে যেতে অন্য পাকে আঁকড়ে ধরতে চায়,
সেরকম একটা হারিয়ে যাওয়া দিনে তুমি ঠিক জানো?
তোমার কি একবারও মনে পড়বে না চিলেকোঠার ছেলেবেলা?
মনে পড়বে না নিষিদ্ধকে পেতে গিয়ে অনেক ভয়ও তোমাকে পেয়েছে?
আগ্রার মতো শহরে তুমি গেছ শ্রাবণ মাসে, দেখেছ কিভাবে সব বয়সজাত পুরুষ-নারীরা প্রেমে ওঠে নামে।
তোমার ভিতরও ক্রমাগত বেড়ে উঠেছে লতা পাতা গুল্মর মতো ধমনীতে রক্তের উচ্ছ্বলতা,
এইসবই তো বাড়ে প্রতিনিয়ত।
অথচ তুমি তো পাখি হতে চেয়েছিলে, যেমন অমলকান্তি রোদ্দুর ।
তুমি তো রোদে হেলান দিয়ে তোমার পরিপাটি মা-কে খুঁজেছিলে,
অথবা মায়ের মতো কাউকে ।
এই যে সকালে তুমি অনিশ্চিত চায়ের কাপে চুমুক দাও, এই ভোরবেলা যেটা তুমি যাপন করো,
তারপর ভোর উত্তীর্ণ বেলায় পড়ে নাও বল্কল ছেড়ে বর্ম, ঋষি থেকে তোমার উত্তরণ ঘটে সৈনিকের...
আর দূরে কোথাও বসে থাকে প্রেমিক মানুষ।
মুখোমুখি (ত্রিদীপ রায়)
বনলতা সেন যাদের আলোকবর্ষ পার করে গেছে-
আমিও তাদের মত প্রতিদিন আয়নার সামনে মুখোমুখি বসি,
ওপারে এক অন্য আমি , অতীত-ভবিষ্যৎ-রূপকথা দের সাথে !
কখনও অতীত খুঁড়ি , রূপকথার মত চোখ ধাঁধানো জীবন , স্বপ্ন দেখা তোমার সাথে।
এপারে আমার বর্তমানে বাঁচা...
প্রতিনিয়ত যোগ্যতম প্রমানের লড়াই , মানুষ খুশী করার দায়, মেনে নেওয়া সবকিছু মুখ বুজে , ওভারটাইম।আয়না কখনও কখনও দূরে সরে যেতে থাকে আমার কাছ থেকে।
যে আমি কে দেখতে চেয়েছিলাম কখনও, যে ছিলো খুব আপনার...
সেও পালাতে থাকে।
ঠিক যেরকম মানুষ হারিয়ে যায় নিজের থেকে কোন কারন ছাড়া!!
এভাবেই দূরে সরে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি,
ঘুম আসে , স্বপ্ন আসে আর আসে সে...
“তোমার আমার লাল নীল সংসার”
পরদিন আবার ঘুম ভাঙ্গে , সকাল হয়...
ইঁদুর দৌড়ে ঢুকে পড়া,
ইঁদুর দৌড়ে ঢুকে পড়া
ফের আয়নাতে ছুঁড়ে দিই প্রশ্ন
এভাবেই এভাবেই...
সেপিয়াতে কিম্বা সাদাকালোয় কেটে যায় আরেকটা নির্বাসিত রাত
আমিও তাদের মত প্রতিদিন আয়নার সামনে মুখোমুখি বসি,
ওপারে এক অন্য আমি , অতীত-ভবিষ্যৎ-রূপকথা দের সাথে !
কখনও অতীত খুঁড়ি , রূপকথার মত চোখ ধাঁধানো জীবন , স্বপ্ন দেখা তোমার সাথে।
এপারে আমার বর্তমানে বাঁচা...
প্রতিনিয়ত যোগ্যতম প্রমানের লড়াই , মানুষ খুশী করার দায়, মেনে নেওয়া সবকিছু মুখ বুজে , ওভারটাইম।আয়না কখনও কখনও দূরে সরে যেতে থাকে আমার কাছ থেকে।
যে আমি কে দেখতে চেয়েছিলাম কখনও, যে ছিলো খুব আপনার...
সেও পালাতে থাকে।
ঠিক যেরকম মানুষ হারিয়ে যায় নিজের থেকে কোন কারন ছাড়া!!
এভাবেই দূরে সরে যেতে যেতে ক্লান্ত হয়ে পড়ি,
ঘুম আসে , স্বপ্ন আসে আর আসে সে...
“তোমার আমার লাল নীল সংসার”
পরদিন আবার ঘুম ভাঙ্গে , সকাল হয়...
ইঁদুর দৌড়ে ঢুকে পড়া,
ইঁদুর দৌড়ে ঢুকে পড়া
ফের আয়নাতে ছুঁড়ে দিই প্রশ্ন
এভাবেই এভাবেই...
সেপিয়াতে কিম্বা সাদাকালোয় কেটে যায় আরেকটা নির্বাসিত রাত
রাস্তা বন্ধু (ঋতুপর্ণা মজুমদার)
অমন একটা রাস্তা আমায় দাও না,
ওই যে দেখেছো ওই রাস্তাটা?
পাইন বনের ফাঁক দিয়ে
এঁকে বেঁকে চলেছে,
খাদের ধার ঘেঁসে কখনো
লাল সুরকির ইতিহাস,
কখনও বা অভিযোগ আধ ভাঙ্গা হয়ে
নীরবের গান সাধে।
পথ চলতির সাথীরা এক পাকদণ্ডী বেয়ে উঠেই হয়ত হাঁপাচ্ছে।
ওদের হাতে এক ঘুঁট জল তুলে দিয়েই আবার চলেছে রাস্তা।
যত দূর চোখ যায় দ্যাখো,
এগিয়ে চলেছে নিজের বাঁক নিজেই এঁকে।
কখনও সঙ্গে পৃথিবী, কখনও রাতের আঁধারে ভাবি,
পথ হারাল না তো?
পথের পথ হারানো কিন্তু ভারি মজার, তাই না;
হারিয়েও নিজেকে সঙ্গে করে আবার পথ চলা।
আছে কি রাস্তার শেষ? শেষ কোথায়?
অমন একটা রাস্তা আমায় দাও না,
শেষ নেই যার।
যেন একবার ছড় তুললেই হল,
বাজতে থাকবে আপনা থেকেই, আজীবন।
তানপুরা তো অমন নয়। তারও পরিত্যাগ আছে।
রেডিও? ব্যাটারি শেষেই কুপোকাত।
যদি বলি চুলে বিলি কেটে দাও, তারও “ধুর ভাল্লাগে না” আছে।
দূরে সরে যাওয়ার আনন্দে কাছে আসার শেষ আছে,
পাখিরা বাড়ি ফিরলেই নিঝুম সন্ধ্যে আছে,
সারাদিন গাড়ির প্যা পোঁ – শুনেছ কখনও? ওদেরও ক্লান্তি আছে।
জীবন শুরু হলেই মৃত্যুবার্ষিকী দিয়ে তার শেষ আছে।
আর ওই রাস্তা টা? শেষ নেই ভেবে দেখো।
বাড়ি ফিরছি না বলে বেরিয়েই –
ঠিক থাকবে তোমায় আঁকড়ে
অজানার ঢালে পায়ের শিকড়ে।
দাও না, অমন একটা রাস্তা আমায়,
বন্ধু চাই,
যার শেষ নেই।
ওই যে দেখেছো ওই রাস্তাটা?
পাইন বনের ফাঁক দিয়ে
এঁকে বেঁকে চলেছে,
খাদের ধার ঘেঁসে কখনো
লাল সুরকির ইতিহাস,
কখনও বা অভিযোগ আধ ভাঙ্গা হয়ে
নীরবের গান সাধে।
পথ চলতির সাথীরা এক পাকদণ্ডী বেয়ে উঠেই হয়ত হাঁপাচ্ছে।
ওদের হাতে এক ঘুঁট জল তুলে দিয়েই আবার চলেছে রাস্তা।
যত দূর চোখ যায় দ্যাখো,
এগিয়ে চলেছে নিজের বাঁক নিজেই এঁকে।
কখনও সঙ্গে পৃথিবী, কখনও রাতের আঁধারে ভাবি,
পথ হারাল না তো?
পথের পথ হারানো কিন্তু ভারি মজার, তাই না;
হারিয়েও নিজেকে সঙ্গে করে আবার পথ চলা।
আছে কি রাস্তার শেষ? শেষ কোথায়?
অমন একটা রাস্তা আমায় দাও না,
শেষ নেই যার।
যেন একবার ছড় তুললেই হল,
বাজতে থাকবে আপনা থেকেই, আজীবন।
তানপুরা তো অমন নয়। তারও পরিত্যাগ আছে।
রেডিও? ব্যাটারি শেষেই কুপোকাত।
যদি বলি চুলে বিলি কেটে দাও, তারও “ধুর ভাল্লাগে না” আছে।
দূরে সরে যাওয়ার আনন্দে কাছে আসার শেষ আছে,
পাখিরা বাড়ি ফিরলেই নিঝুম সন্ধ্যে আছে,
সারাদিন গাড়ির প্যা পোঁ – শুনেছ কখনও? ওদেরও ক্লান্তি আছে।
জীবন শুরু হলেই মৃত্যুবার্ষিকী দিয়ে তার শেষ আছে।
আর ওই রাস্তা টা? শেষ নেই ভেবে দেখো।
বাড়ি ফিরছি না বলে বেরিয়েই –
ঠিক থাকবে তোমায় আঁকড়ে
অজানার ঢালে পায়ের শিকড়ে।
দাও না, অমন একটা রাস্তা আমায়,
বন্ধু চাই,
যার শেষ নেই।
রবিবার, ৭ মে, ২০১৭
অনুবাদ সাহিত্য (অদ্বয় চৌধুরী)
জাকারিয়া তামর সিরিয়ার দামাসকাসে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। আরবী ছোটোগল্পের জগতে জাকারিয়া এক অতি উল্লেখযোগ্য নাম। শিশু সাহিত্যিক হিসেবেও অতি পরিচিত জাকারিয়ার শৈল্পিক সত্তার আয়না হল মূলত তাঁর তীক্ষ্ণ স্যাটায়ারধর্মী লেখা যা সিরিয়ার আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা ও নিয়ম-নীতির অন্তঃস্থল পর্যন্ত তুলে ধরে এক স্বচ্ছ ভঙ্গিমায়। সেরকমই এক স্যাটায়ারধর্মী গ্রন্থ হল ‘Breaking Knees’। ২০০২ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থের গল্পগুলি এমন এক পৃথিবীতে বহন করে নিয়ে যায় পাঠকদের যে পৃথিবী যেমন প্রমোদক তেমনি ভয়াবহ: কুহক, অবৈধ সম্পর্ক, বহুগামিতা, নারীদের অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা, তাদের অবদমিত জীবনযাপন, জীন, দুর্নীতি, স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার— এই সবকিছুই তাঁর আপাতবিনোদক লিখনশৈলীর খোলসের ভিতরে লুকিয়ে আছে।
এখানে জাকারিয়া তামর রচিত ‘Breaking Knees’-এর দুটি অণুগল্পের ভাষান্তরের প্রয়াস করা হয়েছে।
***
১
বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক বৃদ্ধা একটি পার্কে যান যে পার্কের গাছগুলোর সব পাতা ঝরে গেছে। সেখানে তিনি একটি বিরাট পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়ান। মূর্তিটা একজন লম্বা লোকের যাঁর মুখটা কঠিন, আর ডান হাতটা এমন ভঙ্গীতে উঠে রয়েছে যা দেখে সমীহ জাগে। মনে হয় তিনি যেন সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অদৃশ্য অনুগ্রহপ্রার্থীদের আশীর্বাদ করছেন। ওই বৃদ্ধা ভয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন সেই মূর্তির সামনে। তাঁর পা কাঁপতে থাকে। আসলে কিন্তু তাঁর চোখ ছুরির মতো ঝলসে উঠতে চেয়েছিল ওই লোকটার সামনে। ওই লোকটা তাঁর ছেলেদের আর স্বামীকে খুন করেছে যে! কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বৃদ্ধার চোখের স্বভাবসিদ্ধ দুঃখী ও নম্র ভাব কিছুতেই দূর হল না। তাঁর মনে হতে লাগে তিনি যেন কুঁচকে যাচ্ছেন। এবং ক্রমশ কুঁচকে যেতে যেতে তিনি অবশেষে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যান। তাঁর চারপাশের সবকিছুও কুঁচকে যেতে থাকে ক্রমশ, এবং এক সময় তারাও অদৃশ্য হয়ে যায়। কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। শুধু ওই মূর্তিটা থেকে যায়। আর থেকে যায় ওই পাখিগুলো যারা ওই মূর্তিটার উপরে পায়খানা করতে ভালোবাসে।
২
এক স্বামী-স্ত্রী অন্ধকার রাতে শুতে যাওয়ার তোড়জোড় করছিল। স্ত্রী নরম গলায় তার স্বামীকে বলে, “আমার জানা সব মেয়েরাই রাত ভালোবাসে। কিন্তু আমি সহ্য করতে পারি না। কেন পারি না আঁচ করতে পারো?”
“কারণ তুমি রাতের বেলা উপুড় হয়ে শুতে পছন্দ কর, কিন্তু আমি তোমায় চিৎ করে শোয়াই”, কোনো রাখঢাক না রেখেই স্বামী উত্তর দেয়।
স্ত্রী তখন উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “কেন তুমি আমাকে রাতের মাধুর্য বোঝানোর চেষ্টা কর না? আমি একজন নারী, যে কোনো চরম অভিমত পোষণ করে না, কিন্তু যে যুক্তি-প্রমাণ সহ মতামত শুনতে ভালোবাসে”।
হাঁপ ধরে যাওয়া ভাঙা গলায় তার স্বামী তাকে রাত সম্বন্ধে বলতে লাগে। বাইরে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছিল; স্ত্রী তার স্বামীকে আরও বেশি জড়িয়ে ধরে। হিটারে কাঠ পুড়ে শেষ হয়ে গেছে এবং আরও কাঠ দেওয়া জরুরী— স্ত্রী জানায় তার স্বামীকে। কিন্তু স্বামী ওঠে না। বরং সে ওইভাবেই, ওই অবস্থাতেই শুয়ে থাকে। তার মনে হয়, সেই যেন কাঠ আর তার স্ত্রী যেন হিটার।
দেওয়াল কথা (সম্বিত বসু)
দেওয়ালের কান আছে, মুখও। নইলে কানে শোনা কথা সে পাচার করে দেয় কীভাবে? দেওয়ালের জামা বিজ্ঞাপনের পাতলা কাগজ, সিনেমার পোস্টার। গা বেয়ে উঠতে থাকে সময়শামুক। কিন্তু তাছাড়াও দেওয়ালের চামড়ায় মিশে যায় রং। বিপ্লবের রং। রাজনীতির রং। দেওয়ালের চামড়ায় ফুটে উঠতে থাকে সময়ের ট্যাটু। সত্তরের নিষিদ্ধ বিপ্লবের সময়কে নিয়েই এই বই। বলা উচিত, সেই সময়ের দেওয়াল লিখনকে নিয়ে। দেওয়াল লিখন নতুন কিছু নয় কিন্তু দেওয়াল লেখার আত্মকথা নতুন। শুভেন্দু দাশগুপ্তর এই বইটি একইসঙ্গে তাঁর আত্মকথা অথবা আত্মকাহিনির মধ্যে ‘দেওয়াল লিখন’ অংশগুলোকে জুড়ে জুড়ে এই বই যা শেষপর্যন্ত কোনও দেওয়ালেরই আত্মকথা হতে পারত।
‘ভূমিকা’ অংশে শুভেন্দুবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, এই বই প্রস্তুতি হয়েছে মাথায়। মাঝে মাঝে লিখে রাখা হয়েছিল ডায়েরিতে। আবার হারিয়ে গিয়েছিল ডায়েরি। খুঁজে পেয়ে আবার কিছু লিখে রাখা। তা সত্ত্বেও এই বইকে খাপছাড়া লাগে না কোথাও। পাতাগুলোই অনেকাংশে কালো অক্ষরে লেখা দেওয়াল হয়ে যায়।
সব লেখা দেওয়ালে লিখে রাখা যেত না। আপত্তিজনক কিছু হলেই—পছন্দের লেখা না হলে পাটের গোছার জাবদা ব্রাশ দিয়ে লোক লাগিয়ে পুলিশ লেখা মুছিয়ে দিত। লেখার ওপর পোঁচ-পোঁচ শাদা রং চাপিয়ে দিত, এবড়োখেবড়ো।
দেওয়াল লেখায় নানারকম রঙই ব্যবহার করা হতো। কিন্তু নকশালের সময় নানা রঙের ব্যবহার কমে এসেছিল। শুধু লাল আর কালো। লেখক জানাচ্ছেন ‘অন্য রঙে কথা নরম হয়ে যায়। বিপ্লবের রং লাল। কঠিন কথার রং কালো।’ যারা নকশাল আন্দোলন কিংবা সত্তরের ভয়াবহ সময়ের মধ্যে যাননি, তাঁরা হয়তো এই বই ছুঁলে ছুঁতে পারবেন সেই দেওয়াল। যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় না কখনোই। যে দেওয়াল বিপ্লবের মধ্যে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই।
১৪ নং পাতায় একটি ফুলস্কেপ ছবি দু-পাতা জুড়ে। প্রথমবার দেখে দুম করে কেউ উল্টে যেতে পারবেন না। ছবির তো এমনই ক্ষমতা। কিন্তু বাকি সব ছবির থেকে এ-ছবি আলাদা, কারণ এই ছবি দেওয়ালের চোখ দিয়ে আঁকা। ‘এক হও’ শব্দটি মিরর ইমেজে রয়েছে ছবিতে। আর একজন শিল্পী, লিখছেন তুলি দিয়ে। অনেকদিন আগে লেখককে আর্ট কলেজের এক দাদা পরামর্শ দিয়েছিল এইরকম—
এমনভাবেই লিখবি যাতে মানুষ নিজে থেকেই পড়ে, পড়তে আসে। মাথায় ঢুকল তো? এটাই ফান্ডামেন্টাল। দেওয়াল লেখাটাই পলিটিকস। কী লিখবি যেমন পলিটিকস, কীভাবে লিখবি, সেটাও পলিটিকস। দেখানোটাও পলিটিকস।’
দেওয়াল লেখার আত্মকথা পড়তে পড়তে খুবই মনে পড়ে বান্স্কি-র এক্সিট থ্রু দ্যা গিফট শপ ডকুমেন্টারির কথা। ডকুমেন্টারির পাশাপাশি এই বই পড়তে পাঠকের ভালোই লাগবে আশা করা যায়। মনে পড়তে পারে, ভৈকম মহম্মদ বশীরের ‘দেয়াল‘ গল্পটিও, যেখানে দেওয়াল বলে আদৌ আর কিছু থাকছে না দুজন মানুষের মধ্যে। উবে যাচ্ছে। আর এই বইয়ে দেওয়াল যেন এক স্মৃতিফলক ।
অক্ষরের রাজনীতিও লুকিয়ে আছে এই বইতে। কারণ প্রস্তুতি নেই, এমন অবস্থায়ও লিখতে হয়েছে দেওয়ালে। কারণ সরকার-বিরুদ্ধ কথা বলতে গিয়ে হাতের লেখা এঁকেবেঁকে যায়। ওদিকে সরকারের দেওয়াল লিখনগুলো যথেষ্ট সময় নিয়ে, সুন্দরভাবে আঁকা। দেওয়াল লেখার বিপত্তি যে শুধু পুলিশে ছিল তা নয়। তখনও ঈশ্বর গুপ্তর প্রবাদবাক্যটি ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকেতায় আছি’-ই ছিল পরম সত্য। সেই মশার কথা এখানে না উল্লেখ করে পারলাম না—এদের জায়গা পা-এলাকা, পায়ের পাতা, আঙুল, গোড়ালির ওপর, হাঁটু অব্দি, ফুলপ্যান্ট থাকলে অনেকটা এলাকা কামড়মুক্ত। পাজামা, লুঙ্গি থাকলে লড়াই অসম। বসলে টের পাওয়া যায় না। যখন কামড়াত লাফিয়ে উঠতে হত। তুলির টান এদিক-ওদিক। মুছে-টুছে ঠিকঠাক করা সাংঘাতিক কঠিন।
মশা-ই নয়, বাধ সাধত বৃষ্টিও। সদ্য করা রং, পুরোটাই ধুয়ে গেল। তার কষ্টও কম নয়। লেখকের কথাই বলে গেলে শুধু, এ বইয়ের প্রতি অবিচার করা হবে, কারণ এই বইয়ের অলংকরণও অসামান্য। যদিও শিল্পী তাঁর সংস্থার শর্তমাফিক নিজের নাম জানাতে চাননি। কিন্তু সুধী পাঠক, একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন এই তুলির টান আমাদের অতিপরিচিত। মনফকিরা খুব যত্ন নিয়ে ছেপেছেন এই বই। তাঁদের সাধুবাদ জানাই এই দেওয়াল লেখার শেষে।
‘ভূমিকা’ অংশে শুভেন্দুবাবু জানিয়ে দিয়েছেন, এই বই প্রস্তুতি হয়েছে মাথায়। মাঝে মাঝে লিখে রাখা হয়েছিল ডায়েরিতে। আবার হারিয়ে গিয়েছিল ডায়েরি। খুঁজে পেয়ে আবার কিছু লিখে রাখা। তা সত্ত্বেও এই বইকে খাপছাড়া লাগে না কোথাও। পাতাগুলোই অনেকাংশে কালো অক্ষরে লেখা দেওয়াল হয়ে যায়।
সব লেখা দেওয়ালে লিখে রাখা যেত না। আপত্তিজনক কিছু হলেই—পছন্দের লেখা না হলে পাটের গোছার জাবদা ব্রাশ দিয়ে লোক লাগিয়ে পুলিশ লেখা মুছিয়ে দিত। লেখার ওপর পোঁচ-পোঁচ শাদা রং চাপিয়ে দিত, এবড়োখেবড়ো।
দেওয়াল লেখায় নানারকম রঙই ব্যবহার করা হতো। কিন্তু নকশালের সময় নানা রঙের ব্যবহার কমে এসেছিল। শুধু লাল আর কালো। লেখক জানাচ্ছেন ‘অন্য রঙে কথা নরম হয়ে যায়। বিপ্লবের রং লাল। কঠিন কথার রং কালো।’ যারা নকশাল আন্দোলন কিংবা সত্তরের ভয়াবহ সময়ের মধ্যে যাননি, তাঁরা হয়তো এই বই ছুঁলে ছুঁতে পারবেন সেই দেওয়াল। যে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় না কখনোই। যে দেওয়াল বিপ্লবের মধ্যে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রাহুল দ্রাবিড়ের মতোই।
১৪ নং পাতায় একটি ফুলস্কেপ ছবি দু-পাতা জুড়ে। প্রথমবার দেখে দুম করে কেউ উল্টে যেতে পারবেন না। ছবির তো এমনই ক্ষমতা। কিন্তু বাকি সব ছবির থেকে এ-ছবি আলাদা, কারণ এই ছবি দেওয়ালের চোখ দিয়ে আঁকা। ‘এক হও’ শব্দটি মিরর ইমেজে রয়েছে ছবিতে। আর একজন শিল্পী, লিখছেন তুলি দিয়ে। অনেকদিন আগে লেখককে আর্ট কলেজের এক দাদা পরামর্শ দিয়েছিল এইরকম—
এমনভাবেই লিখবি যাতে মানুষ নিজে থেকেই পড়ে, পড়তে আসে। মাথায় ঢুকল তো? এটাই ফান্ডামেন্টাল। দেওয়াল লেখাটাই পলিটিকস। কী লিখবি যেমন পলিটিকস, কীভাবে লিখবি, সেটাও পলিটিকস। দেখানোটাও পলিটিকস।’
দেওয়াল লেখার আত্মকথা পড়তে পড়তে খুবই মনে পড়ে বান্স্কি-র এক্সিট থ্রু দ্যা গিফট শপ ডকুমেন্টারির কথা। ডকুমেন্টারির পাশাপাশি এই বই পড়তে পাঠকের ভালোই লাগবে আশা করা যায়। মনে পড়তে পারে, ভৈকম মহম্মদ বশীরের ‘দেয়াল‘ গল্পটিও, যেখানে দেওয়াল বলে আদৌ আর কিছু থাকছে না দুজন মানুষের মধ্যে। উবে যাচ্ছে। আর এই বইয়ে দেওয়াল যেন এক স্মৃতিফলক ।
অক্ষরের রাজনীতিও লুকিয়ে আছে এই বইতে। কারণ প্রস্তুতি নেই, এমন অবস্থায়ও লিখতে হয়েছে দেওয়ালে। কারণ সরকার-বিরুদ্ধ কথা বলতে গিয়ে হাতের লেখা এঁকেবেঁকে যায়। ওদিকে সরকারের দেওয়াল লিখনগুলো যথেষ্ট সময় নিয়ে, সুন্দরভাবে আঁকা। দেওয়াল লেখার বিপত্তি যে শুধু পুলিশে ছিল তা নয়। তখনও ঈশ্বর গুপ্তর প্রবাদবাক্যটি ‘রেতে মশা দিনে মাছি, এই নিয়ে কলকেতায় আছি’-ই ছিল পরম সত্য। সেই মশার কথা এখানে না উল্লেখ করে পারলাম না—এদের জায়গা পা-এলাকা, পায়ের পাতা, আঙুল, গোড়ালির ওপর, হাঁটু অব্দি, ফুলপ্যান্ট থাকলে অনেকটা এলাকা কামড়মুক্ত। পাজামা, লুঙ্গি থাকলে লড়াই অসম। বসলে টের পাওয়া যায় না। যখন কামড়াত লাফিয়ে উঠতে হত। তুলির টান এদিক-ওদিক। মুছে-টুছে ঠিকঠাক করা সাংঘাতিক কঠিন।
মশা-ই নয়, বাধ সাধত বৃষ্টিও। সদ্য করা রং, পুরোটাই ধুয়ে গেল। তার কষ্টও কম নয়। লেখকের কথাই বলে গেলে শুধু, এ বইয়ের প্রতি অবিচার করা হবে, কারণ এই বইয়ের অলংকরণও অসামান্য। যদিও শিল্পী তাঁর সংস্থার শর্তমাফিক নিজের নাম জানাতে চাননি। কিন্তু সুধী পাঠক, একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন এই তুলির টান আমাদের অতিপরিচিত। মনফকিরা খুব যত্ন নিয়ে ছেপেছেন এই বই। তাঁদের সাধুবাদ জানাই এই দেওয়াল লেখার শেষে।
আত্মহনন (শুভময় দে )
ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে | আবছা চাপ চাপ অন্ধকার | আলো নেই বললেই চলে | মাটি ভেজা | ছোট ছোট কাঁকর মেশানো মার্টি | একটা শালপাতা অর্ধেক মাটির ভেতরে | বেরিয়ে থাকা পাতার অংশটায় ছোট মাঝারি কয়েকটা ফুটো | একটা লাল পিঁপড়ে ফুটোগুলো দিয়ে এদিক ওদিক করছে |পিঁপড়ের মাথা বুক ঘাড় জুড়ে একটা ভাতের কোনা | কোণাটা কাল রাতে কুয়োর পাশে ফেলে দেওয়া ভাতের ওপর, সকালে কাকের ছড়িয়ে ফেলে রাখা টুকরো |চালটা ডিরেক্টর অফ রাইস ডেভলপমেন্টের সাজানো নম্বর অনুযায়ী সি আর চারশো চার ছাপান্ন এক গোত্রের | বানানো হয়েছিল লেবু গাছের শুকনো ডাল পুড়িয়ে একটা মাটির উনোনে | ভাতটা রান্না হবার আধঘন্টা পরে যাকে খেতে দেওয়া হয়, সে কোনোদিন ডিরেক্টর অফ রাইস ডেভলপমেন্টের নাম শোনেনি | ভাত খাবার চল্লিশ মিনিট পড়ে কুয়োর পাড়ে গিয়ে বমি করে, এবং তার আনুমানিক তেরো ঘন্টা পর নদীর ধরে তাকে পোড়ানো হয় | এরপর পুলিশ আসে বাড়িতে এবং সন্ধে নামে |
আমার আর আমার বউয়ের গল্প (সাদিক হোসেন)

কথাটা খুলেই বলি। আমাকে দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি বেশ অসুস্থ। মানে যাকে বলে, কবরের উপর এক পা দিয়ে আছি। অফিস যাচ্ছি না দুমাস হল। এখন সকালবেলা জম্পেশ ব্রেকফাস্ট সেরে ছাদের ঘরটায় শুয়ে থাকি। শুয়ে শুয়ে বউয়ের সংসার আগলানোর বিভিন্ন শব্দ শুনি। এই বাসনকোসনের ঝনঝন তো ঐ ঝিকে হুকুম দিচ্ছে। আবার কখনও আঁচলে চাবি ঘুরিয়ে ডালে রসুনের ফোড়ন দিচ্ছে।
এদিকে দুপুরে লোডশেডিং। মুহুর্তে বিছানা ঘামে ভিজে গেল। দুবার এপাশ ওপাশ করতেই দেখি, সে কথা সটান এসে আঁচল দিয়ে আমার মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। কিছু বলবার আগেই আবার হাতপাখাতে বাতাস তুলেছে। তাই, যা বলছিলুম, আজকাল বউকে দেখে আর কাম চিন্তা মাথায় আসে না।
তবে, আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি, আমার বন্ধুরা কত কামপ্রবণ। ওরা ঘরে এলে ওদের ওপর থেকে নজর সরাই না। গোপনে লক্ষ্য রাখি ওরা কিভাবে আমার বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে। বউ হাঁটলে কোথায় কোথায় চোখ রাখছে। চায়ের কাপ নেবার সময় হাতে হাত ঠেকালো নাকি! ইয়ার্কির ছলে কোন ইশারা দিচ্ছে না তো! কিন্তু বউও তেমন। কিছুতেই আমাকে অটোর সামনের সিটে বসতে দেবে না। বলবে, তুমি না অসুস্থ। আমি ভেড়ার মত পেছনে সেঁধিয়ে যাই। আর দেখি সে ড্রাইভারের ডান দিকে বসে ঠিক টারজানের মত তারাতলা ছুটছে।
তো, এই হল, মোটামুটি আমার আর আমার বউয়ের গল্প। কিন্তু এটাকে কি আর সত্যিকারের গল্প বলা যায়, বলুন? বড় বড় সাহিত্যিকদের ছোট গল্পেও কী সুন্দর ভাবে মহৎ আকাঙ্ক্ষা গুলো পরতে পরতে বোনা থাকে। সে সব গল্পের প্রতিটা শব্দ, বাক্য, প্যারাগ্রাফ আমাদের মধ্যেকার যা কিছু মহৎ, যা কিছু চিরন্তন, যা কিছু মানুষের অস্তিত্বের জন্য উল্লেখযোগ্য – সেইসব কিছুর দিকে ইশারা পাঠায়। মহৎ লেখকদের মহৎ গল্পগুলো তাই আসলে এক একটি সংকেত। ওনাদের লেখা সংকেতময়।
কিন্তু আমার আর বউয়ের মধ্যে সংকেত তো দূরে থাক; ইশারাও নেই।
বসন্তের সন্ধেবেলা। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। আমার এ হেন রোগা শরীরও সাড়া দিচ্ছে তাতে। অথচ সেই স্থূলদেহ সাবধানে ছাদের ঘরে উঠে আসে না একবারও।
আমাদের মধ্যে যা কিছু – তা কেবল – বেঁচে থাকা। বাজার করা, খাওয়া, ইনকাম বাড়ানো, সিরিয়াল দেখা আর বেঁচে থাকা।
কিন্তু এইসব দিয়ে তো আর গল্প হয় না। তাই আমি চাইছিলুম, আমার এই গল্পটার সঙ্গে যেন কোন মহৎ পেইন্টিং বা ফটোগ্রাফ ছাপানো হয়। এই যেমন – রঘু রাইয়ের কিছু স্টিল বা যামিনী রায়ের আঁকা কিংবা খুব ভাল হত যদি ‘পথের পাঁচালি’র কোন দৃশ্য কোন ভাবে দেখানো সম্ভব হত। এই যেমন, অপু সর্বজয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সর্বজয়ার চোখ ছলছল করছে। তবু চোখের পাতা পড়ছে না। সেই চাউনি যেন কত যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা কত যুদ্ধ, কত অসম লড়াই, কত বিপ্লবের সাক্ষী। এই চাউনি চিরন্তন। এই চাউনিকে কেউ টলাতে পারবে না।
কিন্তু আমার বউয়ের চাউনি মোটেই এমন নয়। সে কত অনায়াসে ইঁদুরকে বিষ দিয়ে, আমাকে ভিটামিন খাইয়ে এক বোতল পানি মাথার পাশে রেখে ঘুমোয়।
তখন আমার বউকে ঠিক মায়ের মতই মনে হয়।
অঙ্কন – সৌরভ চৌধুরী
অসুরবধ (শুভাশিস রায়চৌধুরী)
পাশের পাড়ার ক্লাব "মহামায়া সংঘ" বাজারে বেশ নামডাক করেছে বিগত কয়েক বছরে। গতবার তো লায়ন্স ক্লাব থেকে "শ্রেষ্ঠ সিংহ" পুরষ্কারও পেয়েছিল। ওদের সিংহটা নাকি কলকাতার সবথেকে মাসকুলার সিংহ ছিল। প্রতিবার ওদের প্যান্ডেলে কি ভিড় হয় আর আমাদের প্যান্ডেল, মানে "হঠাৎ সংঘ" এর প্যান্ডেলে গুটিকয়েক লোক আসে।এই নিয়ে ক্লাবের প্রেসিডেন্ট পালান মন্ডল,আমাদের পালানদার খুব রাগ।
আমার সাথে দেখা হলেই বেশ আবেগ নিয়ে বলে
-ভুতো, এবার পুজোতে শালা এসপার ওসপার করে দেব। মহামায়া সংঘের পুজোর থেকে দ্বিগুণ লোক আসবে দেখিস, শুধু একটা আইডিয়া আসতে দে মাথায়।
আমিও প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে শুনি। পালানদার প্রতি এক অসম্ভব শ্রদ্ধা বহন করে চলি।অবশ্য তার একটা অন্য কারণ আছে। পালানদার মেয়ে বুগি, মানে বিপাশার সাথে আমার আবার একটু ইয়ে আছে।আছে। তাতে অবশ্য ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই।পালানদাকে দাদা বলে ডাকলেও সে বয়সে আমার থেকে ঢের বড়।
ক্লাবের সিনিয়র বলে আমি দাদা বলে ডাকি আর কি। বুগির সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে তাই কোন টেকনিকাল সমস্যা নেই। তবে কিকরে পালানদা কে বলব ব্যাপারটা সেটা ভাবলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। পালানদার বেশ তাগড়াই চেহারা, কালচে রং,অনেকটা চারমূর্তি ছবির গজাদার মত। যেদিন এসব লটরপটরের ব্যাপারটা জানতে পারবে সেদিন শিওর উদোম ক্যালানি দেবে আমাকে।
যাই হোক দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। পালানদা ঠিক করল যে এবার নতুন কিছু করা হবে পুজোতে। এবার নাকি রোবট দুর্গা আর অসুরের লড়াই হবে। সবাই জানতে চাইলাম সেটা কিরকম। পালানদা বলল,
-আরে দুগ্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অসুর এদের সব মূর্তিগুলোর পায়ের তলায় চাকা থাকবে। মেশিনের সাহায্যে মুর্তিগুলো নড়াচড়া করবে বেদীর উপর।বেদীতে সাদা সাদা মেঘের কাট আউট থাকবে যাতে মনে হয় মেঘের ওপরে লড়াই হচ্চে। সাউন্ড এফেক্টে গুড়ুম গুড়ুম করে বাজের আওয়াজ থাকবে।এক্কেবারে শেষে মাদুগ্গা এসে অসুরের বুকে ত্রিশুল বসিয়ে দিতেই ব্যাকগ্রাউন্ডে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুরু হবে। আর চকমকে লাইটিং তো থাকবেই। পুরো ব্যাপারটা ৫ মিনিটের শো এর মত হবে। একসাথে ৫০ জনকে ঢুকতে দেওয়া হবে।বাইরে লাইন পড়ে যাবে এরকম নতুন স্টাইলের ঠাকুর দেখার।
আমরা সবাই পালানদার নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকলাম। শালা হবু শ্বশুরের মধ্যে একটা পোটেনশিয়াল সনাতন দিন্দা লুকিয়ে আছে ভাবতেই বুকটা গর্বে ভরে গেল।
পুজোর কদিন ভিড় সামলাতে আমরা হিমশিম খেয়ে গেলাম। পুজো সুপারহিট হল আমাদের। বিশেষ করে আমি এত খেটেছিলাম যা পালানদা আমার ওপর প্রচন্ড খুশি হয়ে গেছিল। বুগিকে ফোন করে বললাম যে বিজয়ার কোলাকুলির পরেই পালানদাকে আমাদের ব্যাপারটা বলে দেব। সব ঠিক চলছিল,গোলমালটা বাঁধল নবমী রাতে এসে।
পরেরদিন ভাসান, পুরো পুজোটাই আমরা উৎরে দিয়েছিলাম বলে পালানদা ক্লাবের ছেলেদের জন্য খানাপিনার ব্যাবস্থা করল।রয়্যাল স্ট্যাগ আর চিকেন
পকোড়া। রাত ১ টার পর প্যান্ডেলের এন্ট্রান্স বন্ধ করে দেওয়া হল। আধা লাইট নিভিয়ে প্যান্ডেলের ভেতরেই শুরু হল মোচ্ছব।
তখন প্রায় আড়াইটে বাজে, অধিকাংশ লোকেরই তার কেটে গেছে ততক্ষণে।হঠাৎ বাইরে শুনলাম কিছু লোকের আওয়াজ। বেরিয়ে দেখি মহিলা,পুরুষ, বাচ্চা মিলিয়ে প্রায় জনা তিরিশেক লোক চিল্লামিল্লি করছে। তাদের দাবী যে শো চালু করতে হবে।তারা নাকি লোকমুখে শুনে অনেকদূর থেকে এসেছে আমাদের রোবট দূর্গার লড়াই দেখতে।পালানদা আমাদের বলল,
-কাল তো ভাসান, এরা এতদূর থেকে এসেছে, চল একবার শো দেখিয়েই দি।
বাকিরা গাঁইগুঁই করল কিন্তু ইম্প্রেস করার জন্য আমিই এগিয়ে এলাম। ইলেক্ট্রিশিয়ান বিল্টুকে দেখলাম মদ খেয়ে আউট হয়ে ড্রেনের ধারে কেলিয়ে পড়ে আছে।অনেক ডাকাডাকিতেও উঠলনা।অগত্যা আমিই মেন সুইচ জ্বালিয়ে দিলাম। শো শুরু করার আগে একবার ডেমো দিতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ। অসুর নড়ছেনা।ওদিকে লোকজনেদের বলে দেওয়া হয়েছে যে শো হবে। অনেকবার অন-অফ করতেও অসুরবাবাজীর নো নড়নচড়ন। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। পালানদাকে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে বললাম সব ঘটনা এবং এটাও বোঝালাম যে ক্লাবের সম্মান বাঁচাতে একটাই রাস্তা আছে আর সেটা হল পালানদাকেই অসুর হতে হবে।
পালানদা আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল কিন্ত আমি বললাম,
-এলাকায় এত ভাল চেহারা আর কারো নেই। তুমিই পারবে এটা করতে। ভেরি সিম্পল, খালি গা হও আর অসুরের গয়নাগুলো পরে নাও, তারপর অসুরের কাতানটা হাতে নিয়ে একপা এগোবে আর তারপর তালে তালে একপা পিছোবে।শেষে দুগ্গার ত্রিশুলের সামনে বুক পেতে দিলেই ব্যাস।
পালানদা আমার কথামত খালি গা হয়ে অসুরের গয়না গুলো পরে নিল। তারপর কার্ডবোর্ডের মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল শো শুরু হওয়ার জন্য। আমি সুইচ অন করে দিতেই শো শুরু হল। কার্তিক,লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ সব বেদীর ওপর চলাচল শুরু করল। মাঝখানে দূর্গা আর পালান মন্ডল বাজের তালে তালে নাচতে থাকল।
নাহ্ পালানদা বেশ ভাল পারফর্ম করছে। রোবটের মত বেশ কাঠকাঠ এক্সপ্রেশন দিচ্ছে। হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি পালানদা তাড়াহুড়াতে লুঙ্গি পরেই নেমে গেছে। নীল চেকচেক লুঙ্গি। ভাগ্য ভাল যে মেঘনাদের মত মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করছে বলে লুঙ্গিটা কারো চোখে পড়েনি। তখনই এল সেই চরম মুহূর্ত। কার্ডবোর্ডের মেঘে বোধহয় পেরেক লেগে ছিল আর আমাদের পালানাসুর মনে হয় মেঘের বড় কাছে চলে এসেছিল। পেরেকে লুঙ্গি আটকাতেই সেটা এক ঝটকায় খুলে গেল আর মেঘও লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
বেদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল পালান মন্ডল। কালো শরীরে নীল আলো লেগে যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে।
কানে কুন্ডল, হাতে বাজুবন্ধ, কাঁধের পাশে গব্বরের মত বেল্ট কিন্তু নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত।
দর্শকদের মধ্যে এক বাচ্চা বলে উঠল "এবাবা অসুর ল্যাংটো"। এক মহিলা বলে উঠল " ছি ছি ছি!! কি অসভ্য লোক রে বাবা"। মহিলার স্বামী তো পারলে বেদীতে উঠে মারে আর কি। ক্লাবের ছেলেরা কোনমতে তাকে ধরে রইল।
পালানদা শুধু আমার দিকে একটা শীতল দৃষ্টি তে তাকাল, বুঝলাম যে কি হতে চলেছে এরপর।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার আর বুগির প্রেমের ডুগি বাজিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে উঠলেন "আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে...."
আমার সাথে দেখা হলেই বেশ আবেগ নিয়ে বলে
-ভুতো, এবার পুজোতে শালা এসপার ওসপার করে দেব। মহামায়া সংঘের পুজোর থেকে দ্বিগুণ লোক আসবে দেখিস, শুধু একটা আইডিয়া আসতে দে মাথায়।
আমিও প্রচন্ড উৎসাহ নিয়ে শুনি। পালানদার প্রতি এক অসম্ভব শ্রদ্ধা বহন করে চলি।অবশ্য তার একটা অন্য কারণ আছে। পালানদার মেয়ে বুগি, মানে বিপাশার সাথে আমার আবার একটু ইয়ে আছে।আছে। তাতে অবশ্য ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই।পালানদাকে দাদা বলে ডাকলেও সে বয়সে আমার থেকে ঢের বড়।
ক্লাবের সিনিয়র বলে আমি দাদা বলে ডাকি আর কি। বুগির সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে তাই কোন টেকনিকাল সমস্যা নেই। তবে কিকরে পালানদা কে বলব ব্যাপারটা সেটা ভাবলেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। পালানদার বেশ তাগড়াই চেহারা, কালচে রং,অনেকটা চারমূর্তি ছবির গজাদার মত। যেদিন এসব লটরপটরের ব্যাপারটা জানতে পারবে সেদিন শিওর উদোম ক্যালানি দেবে আমাকে।
যাই হোক দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল। পালানদা ঠিক করল যে এবার নতুন কিছু করা হবে পুজোতে। এবার নাকি রোবট দুর্গা আর অসুরের লড়াই হবে। সবাই জানতে চাইলাম সেটা কিরকম। পালানদা বলল,
-আরে দুগ্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, অসুর এদের সব মূর্তিগুলোর পায়ের তলায় চাকা থাকবে। মেশিনের সাহায্যে মুর্তিগুলো নড়াচড়া করবে বেদীর উপর।বেদীতে সাদা সাদা মেঘের কাট আউট থাকবে যাতে মনে হয় মেঘের ওপরে লড়াই হচ্চে। সাউন্ড এফেক্টে গুড়ুম গুড়ুম করে বাজের আওয়াজ থাকবে।এক্কেবারে শেষে মাদুগ্গা এসে অসুরের বুকে ত্রিশুল বসিয়ে দিতেই ব্যাকগ্রাউন্ডে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চন্ডীপাঠ শুরু হবে। আর চকমকে লাইটিং তো থাকবেই। পুরো ব্যাপারটা ৫ মিনিটের শো এর মত হবে। একসাথে ৫০ জনকে ঢুকতে দেওয়া হবে।বাইরে লাইন পড়ে যাবে এরকম নতুন স্টাইলের ঠাকুর দেখার।
আমরা সবাই পালানদার নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকলাম। শালা হবু শ্বশুরের মধ্যে একটা পোটেনশিয়াল সনাতন দিন্দা লুকিয়ে আছে ভাবতেই বুকটা গর্বে ভরে গেল।
পুজোর কদিন ভিড় সামলাতে আমরা হিমশিম খেয়ে গেলাম। পুজো সুপারহিট হল আমাদের। বিশেষ করে আমি এত খেটেছিলাম যা পালানদা আমার ওপর প্রচন্ড খুশি হয়ে গেছিল। বুগিকে ফোন করে বললাম যে বিজয়ার কোলাকুলির পরেই পালানদাকে আমাদের ব্যাপারটা বলে দেব। সব ঠিক চলছিল,গোলমালটা বাঁধল নবমী রাতে এসে।
পরেরদিন ভাসান, পুরো পুজোটাই আমরা উৎরে দিয়েছিলাম বলে পালানদা ক্লাবের ছেলেদের জন্য খানাপিনার ব্যাবস্থা করল।রয়্যাল স্ট্যাগ আর চিকেন
পকোড়া। রাত ১ টার পর প্যান্ডেলের এন্ট্রান্স বন্ধ করে দেওয়া হল। আধা লাইট নিভিয়ে প্যান্ডেলের ভেতরেই শুরু হল মোচ্ছব।
তখন প্রায় আড়াইটে বাজে, অধিকাংশ লোকেরই তার কেটে গেছে ততক্ষণে।হঠাৎ বাইরে শুনলাম কিছু লোকের আওয়াজ। বেরিয়ে দেখি মহিলা,পুরুষ, বাচ্চা মিলিয়ে প্রায় জনা তিরিশেক লোক চিল্লামিল্লি করছে। তাদের দাবী যে শো চালু করতে হবে।তারা নাকি লোকমুখে শুনে অনেকদূর থেকে এসেছে আমাদের রোবট দূর্গার লড়াই দেখতে।পালানদা আমাদের বলল,
-কাল তো ভাসান, এরা এতদূর থেকে এসেছে, চল একবার শো দেখিয়েই দি।
বাকিরা গাঁইগুঁই করল কিন্তু ইম্প্রেস করার জন্য আমিই এগিয়ে এলাম। ইলেক্ট্রিশিয়ান বিল্টুকে দেখলাম মদ খেয়ে আউট হয়ে ড্রেনের ধারে কেলিয়ে পড়ে আছে।অনেক ডাকাডাকিতেও উঠলনা।অগত্যা আমিই মেন সুইচ জ্বালিয়ে দিলাম। শো শুরু করার আগে একবার ডেমো দিতে গিয়ে দেখি সর্বনাশ। অসুর নড়ছেনা।ওদিকে লোকজনেদের বলে দেওয়া হয়েছে যে শো হবে। অনেকবার অন-অফ করতেও অসুরবাবাজীর নো নড়নচড়ন। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। পালানদাকে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে বললাম সব ঘটনা এবং এটাও বোঝালাম যে ক্লাবের সম্মান বাঁচাতে একটাই রাস্তা আছে আর সেটা হল পালানদাকেই অসুর হতে হবে।
পালানদা আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল কিন্ত আমি বললাম,
-এলাকায় এত ভাল চেহারা আর কারো নেই। তুমিই পারবে এটা করতে। ভেরি সিম্পল, খালি গা হও আর অসুরের গয়নাগুলো পরে নাও, তারপর অসুরের কাতানটা হাতে নিয়ে একপা এগোবে আর তারপর তালে তালে একপা পিছোবে।শেষে দুগ্গার ত্রিশুলের সামনে বুক পেতে দিলেই ব্যাস।
পালানদা আমার কথামত খালি গা হয়ে অসুরের গয়না গুলো পরে নিল। তারপর কার্ডবোর্ডের মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল শো শুরু হওয়ার জন্য। আমি সুইচ অন করে দিতেই শো শুরু হল। কার্তিক,লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ সব বেদীর ওপর চলাচল শুরু করল। মাঝখানে দূর্গা আর পালান মন্ডল বাজের তালে তালে নাচতে থাকল।
নাহ্ পালানদা বেশ ভাল পারফর্ম করছে। রোবটের মত বেশ কাঠকাঠ এক্সপ্রেশন দিচ্ছে। হঠাৎ নিচে তাকিয়ে দেখি পালানদা তাড়াহুড়াতে লুঙ্গি পরেই নেমে গেছে। নীল চেকচেক লুঙ্গি। ভাগ্য ভাল যে মেঘনাদের মত মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করছে বলে লুঙ্গিটা কারো চোখে পড়েনি। তখনই এল সেই চরম মুহূর্ত। কার্ডবোর্ডের মেঘে বোধহয় পেরেক লেগে ছিল আর আমাদের পালানাসুর মনে হয় মেঘের বড় কাছে চলে এসেছিল। পেরেকে লুঙ্গি আটকাতেই সেটা এক ঝটকায় খুলে গেল আর মেঘও লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
বেদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল পালান মন্ডল। কালো শরীরে নীল আলো লেগে যেন পিছলে পিছলে যাচ্ছে।
কানে কুন্ডল, হাতে বাজুবন্ধ, কাঁধের পাশে গব্বরের মত বেল্ট কিন্তু নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত।
দর্শকদের মধ্যে এক বাচ্চা বলে উঠল "এবাবা অসুর ল্যাংটো"। এক মহিলা বলে উঠল " ছি ছি ছি!! কি অসভ্য লোক রে বাবা"। মহিলার স্বামী তো পারলে বেদীতে উঠে মারে আর কি। ক্লাবের ছেলেরা কোনমতে তাকে ধরে রইল।
পালানদা শুধু আমার দিকে একটা শীতল দৃষ্টি তে তাকাল, বুঝলাম যে কি হতে চলেছে এরপর।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার আর বুগির প্রেমের ডুগি বাজিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলে উঠলেন "আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে...."
পালিশের রং (অমিতাভ রায়চৌধুরী)
#এক
“জুতো পাআআআলিইইইসসসসসস...”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ওহ বাবা... সাড়ে আটটা। এখনও খাওয়া বাকি। আজ মনে হচ্ছে পালিশ ছাড়াই অফিস দৌড়তে হবে। একবার উঁকি দিলাম দোতলার বারান্দা থেকে নিচে – হুম ঠিক আমাদের বাড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে এ পাড়ার এক চেটিয়া জুতো পালিশ ওয়ালা। বছর বিশেকের রানা। সেই এক ই ময়লাটে নীল লুঙ্গি, জুতোর কালি লাগা “এক কালে সাদা ছিল” গেঞ্জি, ডান কাঁধে একটা গামছা (মনে হয় মুখ মোছার জন্য), বাঁ কাঁধে এক খানা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, ডান হাতে জুতো পালিশের বাক্স। গত তিন বছরের চেনা মুখ। আমি আর আমার জুতোর চাকরি জীবন শুরু ওর হাতেই। বলা যায় ইন্টারভিউ থেকেই।
ইতস্তত করলাম ক্ষণিক। ডাকব ওকে? নাকি বেরিয়ে যাই? ষ্টেশন একবার শেষ চেষ্টা করব পালিশ টা করানোর... আজ আবার ক’টা কল এ বেরনোর ছিল। কি করব কি করব ভাবতে ভাবতে দেখি বাঁ দিক দিয়ে একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ –“ অ্যাই জুতো... এদিকে এদিকে...” রানা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রে বাবা আজ! “... মা... ও মা... দিলে খেতে?”
বাড়ি টা খুঁজে পেল মনে হয়। আমি কিছু বলার আগেই চলে গেল। ধুস। যাকগে, পরে দেখা যাবে। আবার ঘড়ি দেখলাম... উফ ন’টা দশের লোকাল টা মিস করব নাকি
#দুই
ডান জুতো টা ভাল করে হল রে রানা?”, সন্দেহের চোখে বললাম আমি, “সামনেটা হয়েছে ঠিক করে?” জুতোর সূচালো আগাটা ওর দিকে আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি। আজ আমার হাতে টাইম আছে। কাছেই লেক গার্ডেনস এ একজন ক্লাইন্ট। টাইম দিয়েছে দশটা। ট্রেন এ মিনিট পনের লাগবে। ডকুমেন্ট কালেক্ট করে অফিস ঢুকব। “ঠিক ই তো হইসিললো”, রানা বিরক্ত। তখনই মেয়েলি গলায় আওয়াজ টা কানে গেল... “ও ভাই, এদিকে... ও জুতো পালিশ... এদিকে এদিকে...”
“আসতিছিইই...” দৌড়ল রানা।
কোনদিক থেকে ডাকল? কেই বা ডাকছে এই সময়ে? এই আওয়াজ টা তো নতুন শুনছি... উঁকি মারলাম একটু বাঁ দিকের বাড়ি গুলোয়। কোন বাড়ির দিকে গেল রানা টা? ওই তো এগোচ্ছে... ওটা কি বিল্টুদের বাড়ি? একতলায় নতুন ভাড়া এল নাকি? ধুর যাকগে... পরে দেখব। আমার জুতো টা কি করল ঠিক করে ব্যাটা?
#তিন
“অ্যাই জুতোওলা... ও দাদা... এদিকে এসো না...” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আজও আওয়াজ টা পেলাম। আজ শনিবার। আমার অফিস ছুটি। সকালে যাচ্ছি একটু বাজার। বাবা কে শনি-রবি আর যেতে দিই না, আমিই করার চেষ্টা করি। ঘড়ি দেখলাম। ন’টা বেজে গেছে। শনিবার রানা একটু লেটে আসে। এমনিতেও আজ বিশেষ খরিদ্দার পাবে না, তবু রোজের ডিউটি। ছাড়ে না। জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে নিচে নেমে শুনছি মেয়েলি গলায় অনুনয়ের সুর,” আসো না গো, করে দাও না...” আর রানা কি সব বলছে গজর গজর করতে করতে।
এটা সেই বিল্টূ দের নতুন ভাড়াটে মেয়ে টার গলা না? আজ শনিবারও জুতো পালিশ লাগে করতে? কোথায় চাকরি করে কে জানে। কাল সুমন বলছিল ক্যারাম খেলতে খেলতে, বুড়ো বুড়ি আর একটা ছোট্ট মেয়ে থাকে। মেয়েটি বছর ছয়েক। কিছুদিন হল ভাড়া এসেছে বিল্টূ দের একতালায়।
-“ বুড়ো বুড়ি আর ছোট মেয়ে”, আমার জিগ্যাসু চোখে অবধারিত প্রশ্ন। সুমন একটা শ্রাগ করে চালে মন দিল। ওর সামনে তখন লাল ঘুটি। মাছের চোখ। আর হাতে অর্জুনের ধনুক।
#চার
-“অ্যাই রানা অ্যাই রানা, কি হল রে?” দৌড়ে গেলাম রানার পেছন পেছন। গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে যাচ্ছে পাড়া থেকে। শনিবারের বাজারে বউনি হয়নি বেচারার। তারপর কি হল কে জানে? মেয়েটা ডাকল তো শুনলাম, কিন্তু রানা অত রেগে উঠলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি ওই বুড়ো বুড়ীর? নাকি মেয়েটার? আমি যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি কৌতূহলী।
দৌড়ে রানা কে ধরে ফেললাম আমি। “কি ব্যাপার রে?”, বিল্টূ দের বাড়ির দিকে একবার উঁকি দিয়ে আমি রানা কে ধরলাম, “কি ব্যাপার? রাগ করে পালাচ্ছিস কেন? ওরা কিছু বলল নাকি তোকে?”
-“আর বোলোনাতো বড়দা,” রানার চোখে মুখে যতপরনাস্তি বিরক্তি। এই রোজদিন ডাক দিয়ে যাবে... এদিকে ধরাবে একখান পেলাস্টিকের জুতা পালিশ করতি!
-“প্লাস্টিক!” আমি হতভম্ব।“ প্লাস্টিক” মানে?
-“ যানি না, যাও।” উল্টে আমার উপর রেগে গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে গেল।
পাগল নাকি! মনে মনে ভাবলাম আমি। আর একবার উঁকি দিলাম বাড়িটার দিকে বাজার যেতে যেতে। নাহ। আজ সন্ধ্যেবেলা বলতে হচ্ছে সুমনদের। এতো জম্পেশ একখানা ব্রেকিং নিউজ!
#পাঁচ
সকালের ওই ঘটনার পর থেকেই মনটা উশখুশ করছে। ঠিক কি ব্যাপার খতিয়ে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হবে না। বাজার থেকে ফেরার পর থেকেই খালি মন চলে যাছে বিল্টূদের বাড়ির দিকে। প্লাস্টিকের জুতো পালিশ করতে দিচ্ছে! আজব ব্যাপার! নাহ। একটু দেখেই আসি। স্নান সেরে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ চলেই গেলাম। কিছু একটা বলে ঢুকতে হবে। কি বলি কি বলি? এই ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম। দরজা খোলাই। বিল্টূদের কাজের মেয়েটি উবু হয়ে বারান্দা মুছছে। আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কাউরে খুঁজতিছেন?” উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি।
-“ না মানে... হ্যাঁ মানে ওই আর কি...” কি বলব ঠাওর করতে পারছিলাম না। তখন ই ভেতর থেকে গলা পেলাম, “ কে রে ঝুমা?”
-“কেলাবের দাদা গো” বলে আমার উবু হয়ে মোছা শেষ করতে লাগল ঝুমা।
-“কে?”, ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক। বয়স হয়েছে। মাথা ভর্তি সাদা চুল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
মনে পরে গেল আমার। বেঁটে। বয়েসের ভারে একটু কুঁজো। পরনে খালি গায়ে পইতে আর একটা আলিগড়ী পাজামা।
-“আমি মানে... আমি এ পাড়াতেই থাকি। এই তিনটে বাড়ি পরেই...” সৌম্য ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক কি বলব বুঝে পাচ্ছিলাম না আমি, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল।
-“ভেতরে এসো।”
ঢুকতে যাচ্ছি, ওমা কোথা থেকে এক্তি বাচ্চা মেয়ে এসে আটকে দিল, “একি কি করছ কি করছ। এখুনি মুছে গেল না? পাড়া দিও না! সাইড সাইড দিয়ে এসো!” আমি শুনে অবাক! এতো দেখছি আমার দিদির মেয়ের মতই পাকা বুড়ি! ওর ই বয়েসি হবে মনে হচ্ছে। কতো বলেছিল যেন সুমন? ছয়? না সাত? ভাবতে ভাবতেই দেখি মেয়েটি কলকল করে বলে চলেছে, “ হ্যাঁ তো, আমি ঠিক বলছি তো। মা তো আমাকে শিখিয়েছে যে ভেজা ঘরে পা দিতে নেই...”
আমি হেসে না বোঝার ভান করে বললাম, “কি ভাবে যাব তাহলে? তুমি একটু দেখিয়ে দেবে?” বেশ মজা লাগছিল আমার। মেয়েটি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে তুলে দেখাতে লাগল আমার কেমন করে হাঁটা উচিৎ। হেসে উঠলাম আমরা। দেখলাম মেয়েটির পেছনে এক বয়স্ক মহিলা। নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের স্ত্রী। মেয়েটির দিদা। অথবা ঠাকুমা। ছোট্ট করে গাল টিপে আমি সোফায় বসলাম। ততখনে আমার সপ্রতিভতা ফিরে এসেছে। হেসে বললাম, “শুনলাম নতুন এসেছেন, তাই একটু দেখা করতে এলাম। কিছু অসুবিধা হলে জানাবেন কাকু”।
স্মিত হেসে আমার পাশে বসলেন ভদ্রলোক। “তোমার কাকিমা কে বলি? একটু চা খাবে তো?” আমি অপ্রস্তুত, “না না কাকিমা, কিছু লাগবে না।”
ওমা! দেখি টরটরি পৌঁছে গেছে। “খাও না, খাও না, দিদা খুব ভাল চা করে তো,”
গাল টিপে দিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি নাম তোমার?”
-“ভালনাম লিপ্সা, ডাকনাম নিনি। নি ফর নীলিমা। নি ফর নীলোৎপল। আমার মা আর আমার বাবা।”
-“বাহ, ভারি মিষ্টি নাম তো!”
-“আচ্ছা তুমি প্লেন বানাতে পারো?... দাঁড়াও” কৌতূহলী চোখ জোড়া আমার দিকে চেয়েই অপেক্ষা না করেই কিছু একটা আনতে চলে গেল ভেতরে।কাকু দেখলাম মুখ নিছু করে বসে। কিছু একটা ভাবছেন হয়ত। ঘরের চারিদিকটা দেখলাম আমি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। কোথাও তো কোন অ্যাবনরমালিটি দেখছি না। তাহলে রানাটাই কি কোনো ভুল করল? প্লাস্টিকের জুতো পালিশ?! মনে পরে গেল আমার। ভাবনা ভঙ্গ হল আমার, নিনি এসে গেছে একটা দুমড়ানো খবরের কাগজের একটা পাতা নিয়ে।
-“এই নাও, প্লেন বানিয়ে দাও।” নিনির হাসি হাসি মুখে মিষ্টি মিষ্টি পাকা কথা টুকুনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দিদির মেয়েটা আমাদের বাড়ি এলে সব সময়ে লেপটে থাকে আমাকে।
কাকিমা ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছেন। নিনির গায়ে মৃদু চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “নিনি, যাও ভেতরে যাও আমি আসছি।” নিনির যদিও যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি ভাল করে একটা প্লেন বানিয়ে সোঁ করে ছুড়ে দিলাম সিলিঙের দিকে তাক করে। নিনি ছুটে গেল ধরার জন্য। ধরে নিয়ে এসে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “ জানো কাকু, দাদু দিদা না পারে না প্লেন বানাতে। মা পারে।”
আমি হেসে বললাম, “হুঁ। মা কে বোলো একটা বানিয়ে দেবে।”
-“বলব।” হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল কি মেয়েটা? দরজার বাইরেটায় চোখ ওর তখন।
-“নিনি”, নিনির দিদা ভেতরে নিয়ে গেলেন ওকে, “চল স্নান করবে।”
কখন ফেরে ওর মা? আমার জিজ্ঞাসু চোখ। তবে যে সুমন বলেছিল শুধু বুড়ো বুড়ি আর বাচ্চা মেয়ে? প্রশ্ন করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক দেখছি উশখুশ করছেন। বুঝলাম যে উঠতে হবে। দু চুমুকে চা শেষ করে আমি উঠে পড়লাম।
- “আসি কাকু। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন।” বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম আমি।
- “আসলে..., কাকু কিছু বলতে চাইলেন। ইতস্তত করছেন। “বলুন না”, পায়ে চটি গলাতে গলাতে বললাম।
- “আসলে, নিনির বাবা মা নেই... মানে, মাস ছয়েক হল, মারা গেছে।”
চমকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। কি বলছে কি লোকটা? মারা গেছে? এই ছোট্ট নিনির বাবা মা? নেই? তারা নেই? টুকুনেরই মত। চুলবুলে। টরটরি। দুদিকে দুটো ঝুটি। “কি বলছেন কি?” আমি বেরোতে পারলাম না। ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়।
-“আমার ছেলে বউ। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট... নিনি বেঁচে গেছিল... তবে... তবে মাথায় চোট পেয়েছিল খুব। তিন মাস যমে মানুষে টানাটানি... ফিরে এসেছে... আমাদের এখন ওই একজন ই...” গলা ধরে এল ভদ্রলোকের। চোখের কোল মুছলেন। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ভেতরের ঘরে উঁকি দিলাম। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিনি কে। স্নান হয়ে গেছে ততক্ষণে। বকর বকর করে যাচ্ছে। আর দিদা চুল আঁচড়ে দিচ্ছে।
আর কোন কথা বলতে পারলাম না আমি। এক পা এক পা করে বেরিয়ে আসলাম। পেছন পেছন কাকু। হঠাৎ রানার মুখ টা মনে পড়ল আমার। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাকুর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা কাকু। রানা বলছিল... মানে জুতো পালিশ ছেলে টা... বলছিল আপনারা প্লাস্টিকের জুতো দেন পালিশ করতে...!!!”
আমার দিকে এক পলক তাকালেন কাকু। “বাধ্য হয়ে”, মাথা নিছু করে বললেন কাকু। “বাধ্য হয়ে ডাকতে হয়। অ্যাকসিডেন্টের দিন স্কুলের প্রথম দিন ছিল নিনির। সকালে ওর মা খুব যত্ন করে জুতো পালিশ করে দিয়েছিল। সেটা মনে গেঁথে আছে নিনির। যে কোন পালিশওলা কে দেখলেই ও ওর মায়ের জুতো দিয়ে পালিশ করতে বলে। ওর মায়ের একটাই জুতো আছে এবাড়ী। একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডল। ওটা ওর খুব প্রিয়। আসলে নিনি পুরোপুরি সুস্থ নয়... অ্যাক্সিডেন্টে ও খুব চোট পেয়েছিল মাথায়। ওই সময়ের সব স্মৃতি মুছে গেছে ওর। ও বিশ্বাস করে ওর বাবা মা অফিস গেছে। ফিরে আসবে সন্ধেবেলা। আমরাও হয়ত সেই আসাতেই আছি... ফিরে আসবে ওরা কোনোদিন...” গলা ধরে এল ওনার।
বেরিয়ে পড়লাম আমি। গনগনে রোদ্দুর মাথার উপর। কেউ কোথাও নেই। বাড়ির দিকে এগলাম। সামনে টুকুন। পেছনে নিনি। জুতো পালিশের রঙ এখন আমারও চোখে।
“জুতো পাআআআলিইইইসসসসসস...”
ঘড়ির দিকে তাকালাম। ওহ বাবা... সাড়ে আটটা। এখনও খাওয়া বাকি। আজ মনে হচ্ছে পালিশ ছাড়াই অফিস দৌড়তে হবে। একবার উঁকি দিলাম দোতলার বারান্দা থেকে নিচে – হুম ঠিক আমাদের বাড়ির নিচেই দাঁড়িয়ে এ পাড়ার এক চেটিয়া জুতো পালিশ ওয়ালা। বছর বিশেকের রানা। সেই এক ই ময়লাটে নীল লুঙ্গি, জুতোর কালি লাগা “এক কালে সাদা ছিল” গেঞ্জি, ডান কাঁধে একটা গামছা (মনে হয় মুখ মোছার জন্য), বাঁ কাঁধে এক খানা কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ, ডান হাতে জুতো পালিশের বাক্স। গত তিন বছরের চেনা মুখ। আমি আর আমার জুতোর চাকরি জীবন শুরু ওর হাতেই। বলা যায় ইন্টারভিউ থেকেই।
ইতস্তত করলাম ক্ষণিক। ডাকব ওকে? নাকি বেরিয়ে যাই? ষ্টেশন একবার শেষ চেষ্টা করব পালিশ টা করানোর... আজ আবার ক’টা কল এ বেরনোর ছিল। কি করব কি করব ভাবতে ভাবতে দেখি বাঁ দিক দিয়ে একটা মেয়েলি গলার আওয়াজ –“ অ্যাই জুতো... এদিকে এদিকে...” রানা এদিক ওদিক দেখতে দেখতে রে বাবা আজ! “... মা... ও মা... দিলে খেতে?”
বাড়ি টা খুঁজে পেল মনে হয়। আমি কিছু বলার আগেই চলে গেল। ধুস। যাকগে, পরে দেখা যাবে। আবার ঘড়ি দেখলাম... উফ ন’টা দশের লোকাল টা মিস করব নাকি
#দুই
ডান জুতো টা ভাল করে হল রে রানা?”, সন্দেহের চোখে বললাম আমি, “সামনেটা হয়েছে ঠিক করে?” জুতোর সূচালো আগাটা ওর দিকে আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম আমি। আজ আমার হাতে টাইম আছে। কাছেই লেক গার্ডেনস এ একজন ক্লাইন্ট। টাইম দিয়েছে দশটা। ট্রেন এ মিনিট পনের লাগবে। ডকুমেন্ট কালেক্ট করে অফিস ঢুকব। “ঠিক ই তো হইসিললো”, রানা বিরক্ত। তখনই মেয়েলি গলায় আওয়াজ টা কানে গেল... “ও ভাই, এদিকে... ও জুতো পালিশ... এদিকে এদিকে...”
“আসতিছিইই...” দৌড়ল রানা।
কোনদিক থেকে ডাকল? কেই বা ডাকছে এই সময়ে? এই আওয়াজ টা তো নতুন শুনছি... উঁকি মারলাম একটু বাঁ দিকের বাড়ি গুলোয়। কোন বাড়ির দিকে গেল রানা টা? ওই তো এগোচ্ছে... ওটা কি বিল্টুদের বাড়ি? একতলায় নতুন ভাড়া এল নাকি? ধুর যাকগে... পরে দেখব। আমার জুতো টা কি করল ঠিক করে ব্যাটা?
#তিন
“অ্যাই জুতোওলা... ও দাদা... এদিকে এসো না...” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আজও আওয়াজ টা পেলাম। আজ শনিবার। আমার অফিস ছুটি। সকালে যাচ্ছি একটু বাজার। বাবা কে শনি-রবি আর যেতে দিই না, আমিই করার চেষ্টা করি। ঘড়ি দেখলাম। ন’টা বেজে গেছে। শনিবার রানা একটু লেটে আসে। এমনিতেও আজ বিশেষ খরিদ্দার পাবে না, তবু রোজের ডিউটি। ছাড়ে না। জামার বোতাম লাগাতে লাগাতে নিচে নেমে শুনছি মেয়েলি গলায় অনুনয়ের সুর,” আসো না গো, করে দাও না...” আর রানা কি সব বলছে গজর গজর করতে করতে।
এটা সেই বিল্টূ দের নতুন ভাড়াটে মেয়ে টার গলা না? আজ শনিবারও জুতো পালিশ লাগে করতে? কোথায় চাকরি করে কে জানে। কাল সুমন বলছিল ক্যারাম খেলতে খেলতে, বুড়ো বুড়ি আর একটা ছোট্ট মেয়ে থাকে। মেয়েটি বছর ছয়েক। কিছুদিন হল ভাড়া এসেছে বিল্টূ দের একতালায়।
-“ বুড়ো বুড়ি আর ছোট মেয়ে”, আমার জিগ্যাসু চোখে অবধারিত প্রশ্ন। সুমন একটা শ্রাগ করে চালে মন দিল। ওর সামনে তখন লাল ঘুটি। মাছের চোখ। আর হাতে অর্জুনের ধনুক।
#চার
-“অ্যাই রানা অ্যাই রানা, কি হল রে?” দৌড়ে গেলাম রানার পেছন পেছন। গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে যাচ্ছে পাড়া থেকে। শনিবারের বাজারে বউনি হয়নি বেচারার। তারপর কি হল কে জানে? মেয়েটা ডাকল তো শুনলাম, কিন্তু রানা অত রেগে উঠলো কেন? কিছু হয়েছে নাকি ওই বুড়ো বুড়ীর? নাকি মেয়েটার? আমি যত না চিন্তিত, তার চেয়ে বেশি কৌতূহলী।
দৌড়ে রানা কে ধরে ফেললাম আমি। “কি ব্যাপার রে?”, বিল্টূ দের বাড়ির দিকে একবার উঁকি দিয়ে আমি রানা কে ধরলাম, “কি ব্যাপার? রাগ করে পালাচ্ছিস কেন? ওরা কিছু বলল নাকি তোকে?”
-“আর বোলোনাতো বড়দা,” রানার চোখে মুখে যতপরনাস্তি বিরক্তি। এই রোজদিন ডাক দিয়ে যাবে... এদিকে ধরাবে একখান পেলাস্টিকের জুতা পালিশ করতি!
-“প্লাস্টিক!” আমি হতভম্ব।“ প্লাস্টিক” মানে?
-“ যানি না, যাও।” উল্টে আমার উপর রেগে গজর গজর করতে করতে রানা বেরিয়ে গেল।
পাগল নাকি! মনে মনে ভাবলাম আমি। আর একবার উঁকি দিলাম বাড়িটার দিকে বাজার যেতে যেতে। নাহ। আজ সন্ধ্যেবেলা বলতে হচ্ছে সুমনদের। এতো জম্পেশ একখানা ব্রেকিং নিউজ!
#পাঁচ
সকালের ওই ঘটনার পর থেকেই মনটা উশখুশ করছে। ঠিক কি ব্যাপার খতিয়ে না দেখা পর্যন্ত শান্তি হবে না। বাজার থেকে ফেরার পর থেকেই খালি মন চলে যাছে বিল্টূদের বাড়ির দিকে। প্লাস্টিকের জুতো পালিশ করতে দিচ্ছে! আজব ব্যাপার! নাহ। একটু দেখেই আসি। স্নান সেরে বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ চলেই গেলাম। কিছু একটা বলে ঢুকতে হবে। কি বলি কি বলি? এই ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম। দরজা খোলাই। বিল্টূদের কাজের মেয়েটি উবু হয়ে বারান্দা মুছছে। আমাকে বাইরে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “কাউরে খুঁজতিছেন?” উঠে দাঁড়ালো মেয়েটি।
-“ না মানে... হ্যাঁ মানে ওই আর কি...” কি বলব ঠাওর করতে পারছিলাম না। তখন ই ভেতর থেকে গলা পেলাম, “ কে রে ঝুমা?”
-“কেলাবের দাদা গো” বলে আমার উবু হয়ে মোছা শেষ করতে লাগল ঝুমা।
-“কে?”, ততক্ষণে বাইরে বেরিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক। বয়স হয়েছে। মাথা ভর্তি সাদা চুল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
মনে পরে গেল আমার। বেঁটে। বয়েসের ভারে একটু কুঁজো। পরনে খালি গায়ে পইতে আর একটা আলিগড়ী পাজামা।
-“আমি মানে... আমি এ পাড়াতেই থাকি। এই তিনটে বাড়ি পরেই...” সৌম্য ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক কি বলব বুঝে পাচ্ছিলাম না আমি, খেই হারিয়ে যাচ্ছিল।
-“ভেতরে এসো।”
ঢুকতে যাচ্ছি, ওমা কোথা থেকে এক্তি বাচ্চা মেয়ে এসে আটকে দিল, “একি কি করছ কি করছ। এখুনি মুছে গেল না? পাড়া দিও না! সাইড সাইড দিয়ে এসো!” আমি শুনে অবাক! এতো দেখছি আমার দিদির মেয়ের মতই পাকা বুড়ি! ওর ই বয়েসি হবে মনে হচ্ছে। কতো বলেছিল যেন সুমন? ছয়? না সাত? ভাবতে ভাবতেই দেখি মেয়েটি কলকল করে বলে চলেছে, “ হ্যাঁ তো, আমি ঠিক বলছি তো। মা তো আমাকে শিখিয়েছে যে ভেজা ঘরে পা দিতে নেই...”
আমি হেসে না বোঝার ভান করে বললাম, “কি ভাবে যাব তাহলে? তুমি একটু দেখিয়ে দেবে?” বেশ মজা লাগছিল আমার। মেয়েটি পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের উপর দাঁড়িয়ে পা উঁচু করে তুলে দেখাতে লাগল আমার কেমন করে হাঁটা উচিৎ। হেসে উঠলাম আমরা। দেখলাম মেয়েটির পেছনে এক বয়স্ক মহিলা। নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের স্ত্রী। মেয়েটির দিদা। অথবা ঠাকুমা। ছোট্ট করে গাল টিপে আমি সোফায় বসলাম। ততখনে আমার সপ্রতিভতা ফিরে এসেছে। হেসে বললাম, “শুনলাম নতুন এসেছেন, তাই একটু দেখা করতে এলাম। কিছু অসুবিধা হলে জানাবেন কাকু”।
স্মিত হেসে আমার পাশে বসলেন ভদ্রলোক। “তোমার কাকিমা কে বলি? একটু চা খাবে তো?” আমি অপ্রস্তুত, “না না কাকিমা, কিছু লাগবে না।”
ওমা! দেখি টরটরি পৌঁছে গেছে। “খাও না, খাও না, দিদা খুব ভাল চা করে তো,”
গাল টিপে দিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কি নাম তোমার?”
-“ভালনাম লিপ্সা, ডাকনাম নিনি। নি ফর নীলিমা। নি ফর নীলোৎপল। আমার মা আর আমার বাবা।”
-“বাহ, ভারি মিষ্টি নাম তো!”
-“আচ্ছা তুমি প্লেন বানাতে পারো?... দাঁড়াও” কৌতূহলী চোখ জোড়া আমার দিকে চেয়েই অপেক্ষা না করেই কিছু একটা আনতে চলে গেল ভেতরে।কাকু দেখলাম মুখ নিছু করে বসে। কিছু একটা ভাবছেন হয়ত। ঘরের চারিদিকটা দেখলাম আমি। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। কোথাও তো কোন অ্যাবনরমালিটি দেখছি না। তাহলে রানাটাই কি কোনো ভুল করল? প্লাস্টিকের জুতো পালিশ?! মনে পরে গেল আমার। ভাবনা ভঙ্গ হল আমার, নিনি এসে গেছে একটা দুমড়ানো খবরের কাগজের একটা পাতা নিয়ে।
-“এই নাও, প্লেন বানিয়ে দাও।” নিনির হাসি হাসি মুখে মিষ্টি মিষ্টি পাকা কথা টুকুনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। দিদির মেয়েটা আমাদের বাড়ি এলে সব সময়ে লেপটে থাকে আমাকে।
কাকিমা ততক্ষণে চা নিয়ে এসেছেন। নিনির গায়ে মৃদু চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে বললেন, “নিনি, যাও ভেতরে যাও আমি আসছি।” নিনির যদিও যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। আমি ভাল করে একটা প্লেন বানিয়ে সোঁ করে ছুড়ে দিলাম সিলিঙের দিকে তাক করে। নিনি ছুটে গেল ধরার জন্য। ধরে নিয়ে এসে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, “ জানো কাকু, দাদু দিদা না পারে না প্লেন বানাতে। মা পারে।”
আমি হেসে বললাম, “হুঁ। মা কে বোলো একটা বানিয়ে দেবে।”
-“বলব।” হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল কি মেয়েটা? দরজার বাইরেটায় চোখ ওর তখন।
-“নিনি”, নিনির দিদা ভেতরে নিয়ে গেলেন ওকে, “চল স্নান করবে।”
কখন ফেরে ওর মা? আমার জিজ্ঞাসু চোখ। তবে যে সুমন বলেছিল শুধু বুড়ো বুড়ি আর বাচ্চা মেয়ে? প্রশ্ন করা উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। ভদ্রলোক দেখছি উশখুশ করছেন। বুঝলাম যে উঠতে হবে। দু চুমুকে চা শেষ করে আমি উঠে পড়লাম।
- “আসি কাকু। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন।” বেরিয়ে যেতে যেতে বললাম আমি।
- “আসলে..., কাকু কিছু বলতে চাইলেন। ইতস্তত করছেন। “বলুন না”, পায়ে চটি গলাতে গলাতে বললাম।
- “আসলে, নিনির বাবা মা নেই... মানে, মাস ছয়েক হল, মারা গেছে।”
চমকে পেছন ফিরে তাকালাম আমি। কি বলছে কি লোকটা? মারা গেছে? এই ছোট্ট নিনির বাবা মা? নেই? তারা নেই? টুকুনেরই মত। চুলবুলে। টরটরি। দুদিকে দুটো ঝুটি। “কি বলছেন কি?” আমি বেরোতে পারলাম না। ধপ করে বসে পড়লাম সোফায়।
-“আমার ছেলে বউ। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট... নিনি বেঁচে গেছিল... তবে... তবে মাথায় চোট পেয়েছিল খুব। তিন মাস যমে মানুষে টানাটানি... ফিরে এসেছে... আমাদের এখন ওই একজন ই...” গলা ধরে এল ভদ্রলোকের। চোখের কোল মুছলেন। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ভেতরের ঘরে উঁকি দিলাম। পরদার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নিনি কে। স্নান হয়ে গেছে ততক্ষণে। বকর বকর করে যাচ্ছে। আর দিদা চুল আঁচড়ে দিচ্ছে।
আর কোন কথা বলতে পারলাম না আমি। এক পা এক পা করে বেরিয়ে আসলাম। পেছন পেছন কাকু। হঠাৎ রানার মুখ টা মনে পড়ল আমার। ঘুরে দাঁড়িয়ে কাকুর হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা কাকু। রানা বলছিল... মানে জুতো পালিশ ছেলে টা... বলছিল আপনারা প্লাস্টিকের জুতো দেন পালিশ করতে...!!!”
আমার দিকে এক পলক তাকালেন কাকু। “বাধ্য হয়ে”, মাথা নিছু করে বললেন কাকু। “বাধ্য হয়ে ডাকতে হয়। অ্যাকসিডেন্টের দিন স্কুলের প্রথম দিন ছিল নিনির। সকালে ওর মা খুব যত্ন করে জুতো পালিশ করে দিয়েছিল। সেটা মনে গেঁথে আছে নিনির। যে কোন পালিশওলা কে দেখলেই ও ওর মায়ের জুতো দিয়ে পালিশ করতে বলে। ওর মায়ের একটাই জুতো আছে এবাড়ী। একটা প্লাস্টিকের স্যান্ডল। ওটা ওর খুব প্রিয়। আসলে নিনি পুরোপুরি সুস্থ নয়... অ্যাক্সিডেন্টে ও খুব চোট পেয়েছিল মাথায়। ওই সময়ের সব স্মৃতি মুছে গেছে ওর। ও বিশ্বাস করে ওর বাবা মা অফিস গেছে। ফিরে আসবে সন্ধেবেলা। আমরাও হয়ত সেই আসাতেই আছি... ফিরে আসবে ওরা কোনোদিন...” গলা ধরে এল ওনার।
বেরিয়ে পড়লাম আমি। গনগনে রোদ্দুর মাথার উপর। কেউ কোথাও নেই। বাড়ির দিকে এগলাম। সামনে টুকুন। পেছনে নিনি। জুতো পালিশের রঙ এখন আমারও চোখে।
এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)