বুধবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৭

সূর্যস্নাত / সৌমী ভট্টাচার্য্য

#১
সাল ১৯২৫। ব্রিটিশ শাসন তার প্রজাবান্ধব মুখোশ ছেড়ে ততোদিনে চূড়ান্ত ভাবে ভারতের বুকে পদাঘাত করতে শুরু করেছে। বাংলার আন্দোলনকে কূটনৈতিকভাবে দমন করতে তার পাঁজরের ওপর সৃষ্টি করা হয়েছে সীমারেখার গভীর ক্ষতচিহ্ন। কিন্তুু তাতে শুধুমাত্র ক্ষোভই বেড়েছে যা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরে আন্দোলনের ভিতকে আরো জোরদার করেছে। কবির কলম থেকে শুরু করে জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ পযর্ন্ত, দেশবন্ধুর কন্ঠ থেকে শুরু করে নিপিড়িত জমিদারদের চাপা আর্তনাদ পর্যন্ত সর্বত্রই ধ্বনিত হচ্ছে 'বন্দেমাতরম্'।

এরকমই এক চিন্হিত জমিদার দেবিকাপ্রসাদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গোপন অভিযোগ দায়ের হয়েছে যে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারী এক সশস্ত্র বিপ্লবীকে আশ্রয় দিয়েছেন তাঁরই প্রাসাদপম অট্টালিকাটিতে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই মোসায়েবটি এও জানিয়েছে যে গত সোমবার মানে পরশু রাতে যে ইলিয়াস সাহেবের বাগানবাড়িতে হামলা হয়েছিল তাতে ওই ব্যাটাই ছিলো নাটের গুরু। বাড়িটায় ছিলো বলতে অল্প কিছু টাকাপয়সা আর খান তিনেক পুরোনো রাইফেল। পুলিশ খবর পেয়ে তড়িঘড়ি পৌঁছতে ওরা সবাই পালাতে পারে না। একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর আরেকজনের মাথায় আঘাত লাগে। এই সম্ভবত উল্লেখিত মুর্তিমান। আজ রাতেই জমিদারবাড়ি ঘেরাও করতে হবে। দেবিকাপ্রসাদ অতি অহংকারী লোক। তাকে শাস্তি দেবার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। থানার ছোটবাবু হার্লড সাহেবের চোখ চকচক করে উঠলো।
ডেভিড হার্লড এখন বড়বাবু রিচার্ড মর্গান সাহেবের অনুপস্থিতিতে এই থানার সর্বময় কর্তা। তিনি জানেন যতোই পুলিশি শক্তি তাঁর সঙ্গে থাক না কেন স্থানীয় নেটিভ লোকজন ওই দেবিকাপ্রসাদকে ভগবানের মতো ভক্তি করে। এছাড়া ওর বাবার জমানার কিছু প্রাক্তন পাইক পেয়াদাও ধারেকাছে থাকে যারা এই জমিদারির ভাঁটার সময়ও নুনের দাম দিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছপা হবে না। তাই সাহেব ঠিক করলেন গোটা পনেরো জন পুলিশ নিয়ে হঠাৎ ই হানা দেবেন আর গিয়েই সব কটি দরজা সিল করে দেবেন। তারপর চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে বার করে আনবেন আসামিকে। তারপর তো তাকে ফাঁসিতে চড়াতে দেরী হবে না। একই কেসে দেবিকাকেও ফাঁসানো যাবে। তাঁর চোখের সামনে জীবনে উন্নতির পথটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

#২
খানিকটা হলোও কাজ সেই পরিকল্পনা মাফিক। বরং বেগ পেতেই হলো না। সদর দরজা খোলাই ছিলো। হুড়মুড়্ করে ঢুকে পরলেন ফোর্স নিয়ে। কিন্তু অপ্রস্তুত হলেন যে সেখানে স্থানীয় লোকের ভিড় দেখে। চারপাশের লোকজনের চাপা গুঞ্জন আর অন্দরমহল থেকে ভেসে আসা কান্নার রোলে তিনি ঠিকই বুঝলেন কেউ মারা গেছে। এই চূড়ান্ত দূর্ভাগ্যের জন্যে তিনি বলে উঠলেন, "মাই গড!"
তবে তিনি দমবার পাত্র নন। জমিদারবাড়ির মানচিত্রটাও কিছু জটিল ছিলো না। প্রতি দরজায় পাহারা বসালেন যাতে কেউ বেরোতে না পারে আর নির্দেশ দিলেন বন্দুক উঁচিয়ে রাখতে। তিনি জানেন রাজভক্তি যতই থাক না কেন বন্দুকের সামনে সাধারণত তা আর টেঁকে না। তিনি জমিদারবাবুকে তলব করে বৈঠকখানার ঘরটা ফাঁকা করার নির্দেশ দিলেন।  মাতৃবিয়োগের যন্ত্রনায় জর্জরিত দেবিকাপ্রসাদ ভেতরে ঢুকতেই হার্লড সাহেব সরাসরি অভিযোগ করলেন যে তিনি জানেন কি খতরনক ব্যক্তি এখানে আশ্রয় পেয়েছে। তিনি এও জানেন যে খোদ জমিদারবাবুর প্রশ্রয়েই ঘটেছে এই কাজ অতয়েব তাঁদের তল্লাশিতে যেন কোনো বাধা না দেয়া হয় আর ভুলেও যেন কেউ পালাতে না চেষ্টা করে। করলেই নিশ্চিত মৃত্যু।

ঘরে উপস্থিত ছিল নবীন আর বলভদ্র। নবীন হলো এই জমিদারির নব্যনিযুক্ত নায়েব, প্রাক্তন নায়েব শশীধর বাবুর ছেলে। বলভদ্র অনেকদিনের পুরোনো গোমস্তা। সাহেবের কথা শুনে তাদের মুখ রক্তবর্ণ ধারন করলো। দেবিকাপ্রসাদ চোখ বুজলেন। তারপর নির্নিমেষ চক্ষে আকাশের দিকে তাকালেন, বললেন, "হা ঈশ্বর!" তাঁর দুচোখে তখন বিদ্যুতের চাহনি।
তারপর  নিমেষে নিজেকে সংযত করে ওদের দুহাত তুলে আশ্বস্ত করলেন। করজোড়ে সাহেবের দিকে তাকিয়ে নিবেদন করলেন, সবেমাত্র তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়েছে। এখনই কি এর প্রয়োজন আছে?  কাল সকালে না হয় এ তল্লাশি হোক। কিন্তু সাহেব তা মানবেন কেন! তিনি তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলেন না! বেশ বুঝতে  পারলেন দেবিকা পড়েছেন জালে। ছেলেটাকে বার করার জন্য এখন ফিকির খুঁজছেন। অট্টহাসি দিয়ে উড়িয়ে দিলেন আর্জিখানা। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে  দিলেন তল্লাশি  তিনি এখনই করবেন। শুধু তাই নয় তাতে অন্দরমহলও ছাড় পাবে না। দেবিকাপ্রসাদের চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো। নবীনকে ইশারা করলেন। ভেতরে খবর দেয়া দরকার। সে কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে এলো বৈঠকখানায়। বললো, "কত্তামা বলে পাটালেন গিয়ে, তালাশ যদি করতে হয় তো মায়েরা সবাই বড়মাকে নিয়ে নাচের ঘরে থাকবেন। সাহেব যা খুঁজতে এসেছেন খুঁজবেন তখন। আর কত্তা মশাই, তার আগে আপনাকে একবার তিনি ভেতরবাড়িতে ডাকছেন।"

কত্তামা বলতে দেবিকাপ্রসাদের দ্বিতীয়া ধর্মপত্নী্। প্রথমজন, কমলাসুন্দরী প্রসবকালে মারা যান একটি পুত্রসন্তান রেখে। কমলার পরের বোন অলকাই দু'মাসের  শিশুটিকে বুকে টেনে নেয়। মা ব্রজবালা দাসী বুঝতে পেরেছিলেন পারলে এই মেয়েই পারবে তার মায়ের জায়গাটা নিতে। তারপর কুড়িটা বছর কেটে গেছে। দেবিকার দুই কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। খোকা, মানে অবনীপ্রসাদ বিয়ে করে নি। ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গিয়েছে। অলকার মন তারই পথ চেয়ে বসে থাকে। কিন্তু সংসার বড় বালাই। ওদের বিয়ের পর থেকেই ব্রজবালা সংসারের দায়ভার থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। তখন থেকেই এই বিশাল সংসারের খুঁটিনাটি সব অলকার নখদর্পণে। সংসারে তার কথাই শেষ কথা। এমনকি কর্তারও ক্ষমতা নেই সে কথার নড়চড় করবার।

হার্লড দেখলেন মোটামুটি তল্লাশীর বিষয়টা অন্দরমহল থেকেও মেনে নিয়েছে। জোড় করতে হয়নি। হয়তো ছেলেটার বিষয়ে গিন্নী কিছুই জানে না। জানলে নিজের স্বামীর এতবড় সর্বনাশ করতে পারতেন না। তিনি রাজি হলেন৷ তিনি জানেন হিন্দুদের কাছে এই অন্দরমহল ব্যাপারটা কতটা সংবেদনশীল। বাড়ির মেয়েদের তারা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখতে চায়। এখন অবশ্য কলকাতায় মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু এই চাটগাঁতে সে ছাপ পরেনি। একে তো জমিদারের অন্ত:পুর তল্লাশী তাও আবার বিধর্মী পুরুষের উপস্থিতি - এর চেয়ে বেশী  কিছু চাপালে জমায়েত লোকজন ক্ষেপে উঠবে। দেবিকাপ্রসাদকে বললেন তাড়াতাড়ি করতে।

মিনিট কুড়ি পরে নবীন খবর দিলো, মেয়েরা জলসাঘরে জড়ো হয়েছে। দেবিকা বললেন, “সাহেব এবার আসতে পারেন। নবীন আপনাদের পথ দেখাবে।“
বৈঠকখানার পরে একটা লম্বা বারান্দা দুপাশে দুই দুই করে ছোট ছোট চারটে ঘর। দারোয়ান, নায়েব, গোমস্তারা থাকেন। তারপর একটা চৌকোনা বড় উঠোন। আগামীকাল পূর্ণিমা তাই দেখতে কিছু অসুবিধে হয় না। উঠোনের পূর্ব আর উত্তরের দিকটা জুড়ে রয়েছে ফুলগাছের বাগান। দক্ষিণের দিকে একটা ছোট মন্দির। তার সামনে কিছুটা অংশে খোঁড়া চলছে। একটা পাতকুয়ো বসবে আর স্তুপিকৃত মাটি দিয়ে মন্দিরের চাতাল বাড়ানো হবে নবীন জানালো। ব্রজবালা এরকম স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। মায়ের সখ জানতে পেরে ছেলেও কাজ শুরু করেছিল। "কারো কারো ভাগ্যে সব দেয় কিন্ত্তু সুখ দেয় না। দেখে যেতে পারলেন না বড়মা।" নবীনের চোখের কোণা জলে ভরে উঠলো। মন্দিরের ভিতরে একটা বাইরে যাবার দরজা। মন্দিরের গা দিয়ে উঁচু পাঁচিল উঠে গেছে। তারই গায়ে আর একটা দরজা। হার্লড নিশ্চিন্ত হলেন যে তাঁর বাহিনী বাইরে থেকে দরজাগুলো ঘিরে ফেলেছে। পশ্চিম আর উত্তর দিকে ঘরগুলো। মোট বারোটা ঘর দুটি তলায় সমানভাবে বিন্যস্ত। নবীন জানালেন নিচেরগুলোর একটিতে তাঁর, একটিতে গোমস্তার পরিবার থাকে আর একটায় বাড়ির রাধুনীর পরিবার থাকে। বাকি দুটিতে দারোয়ানের পরিবার ও দুজন ঝি থাকে। কার্যত এখন ফাঁকা করা হয়েছে। হার্লড পাঁচজন পুলিশকে নিচটা সার্চ করতে বলে তিনজনকে নিয়ে ওপরে উঠে এলেন। উত্তর পশ্চিম কোণ ধরে সিঁড়িটা উঠেছে। নিচের মতোই পশ্চিম আর উত্তরে তিনটে তিনটে করে ঘর। পশ্চিমের ঘরগুলো বাড়ির ছেলে, মেয়ে জামাইদের, ওরা এলে থাকে। একটা বাদে এখন সেগুলো বন্ধ আছে। বড়মেয়ে কুমুদিনী অন্তঃসত্বা। মাঝের ঘরটিতে এখন সে মাস চারেক হলো আছে তার প্রথম পুত্রকে নিয়ে। হার্লড চাবি আনিয়ে ওগুলো খোলানোর ব্যবস্থা করলেন। নিজে গেলেন উত্তরে জমিদার ও তাঁর মায়ের কক্ষের দিকে। নবীন তাঁর বড়মার ঘরে শুধু ঢুকলো না। সৎকার না করা পর্যন্ত ওঘরে ঢোকা অনুচিত। সাহেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হলো কারণ তন্নতন্ন করেও কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলো না। এমনকি চোখে পরার মতো অবাঞ্চিত কিছুও দেখলেন না। নির্দেশ দেয়া আছে বাহিনীর কেউ যখনই তার টিকির নাগাল পাবে যেন বন্দুক দেগে জানান দেয়। তাঁর শাপদের মতো খাড়া কানেও তেমন কোনো শব্দ ধরা পরলো না।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে হার্লডের দূর্গা মন্দিরটা চোখে পড়লো। দুজন কে ওপরেই মোতায়েন করে তিনি আর একজনের সাথে চলে এলেন মন্দিরের সামনে। নবীনও এসেছিলো পিছু পিছু। এবার সাহেবের মনভাব বুঝতে পেরে তার বুকটা কেঁপে উঠলো।পেছন থেকে গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো নবীন। তারপর সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললো, "মায়ের মন্দিরটা ছেড়ে দিন না সাহেব, রোজকার রোজ পূজো হয়।"
সাহেবের দৃষ্টি স্থির হলো৷ দরজায় তালা নেই তবে ভেজানো আছে৷ নবীন আবারও কাতর গলায় বললো, "সাহেবরা ঢুকবেন না দয়া করে। আপনারা ঢুকলে বড় অকল্যাণ হয়ে যাবে।"
সাহেবের শুরু থেকেই ইচ্ছে ছিলো নেটিভদের সংস্কারে না হাত দেবার কিন্তু মন উথালপাথাল করতে লাগলো ওই রূদ্ধদ্বারের ভেতরে কি আছে দেখার জন্য। মন বলছে ভেতরে একবার উঁকি দেয়া দরকার। এগিয়ে গিয়ে আলতো হাতের চাপ দিলেন। দরজা খুললো না। নবীন এবার দৌড়ে এসে হার্লডের গামবুট পরিহিত পা জড়িয়ে ধরলো। এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে থাকলেন, "ঢুকবেন না সাহেব, ঢুকবেন না! বড় অধম্য হয়ে যাবে। সব্বনাশ হয়ে যাবে।"
অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সাহেব কষিয়ে মারলেন এক ধাক্কা। নবীন ছিটকে পরলো পাতকুয়ো খোঁড়া স্তুপিকৃত মাটি আর সুরকির মধ্যে। সিঁড়িতে ঘষা খেয়ে হাত পা ছড়ে জ্বালা করে উঠলো। গোঁঙানির মধ্যেও সে পাখিপড়ার মতো বলে যেতে লাগলো, "ঢুকবেন না সাহেব, ঢুকবেন না! ধম্যে সইবে না।"
হার্লড এবার দরজায় সজোরে ধাক্কাটা দিলেন। তবু খুললো না। সাথে এও বেশ বোঝা গেলো সেটা ভেতর থেকে বন্ধ রয়েছে। হার্লডের মনে এবার সন্দেহের কোনো অবকাশ রইলো না। চেঁচিয়ে বললেন, "ওপেন দ্য ডোওর। আই নোও ইউ আ দেয়্যর। ডরজা না খুলিলে টা ভাঙ্গিয়া ফেলিব।" দরজা খুললো না। "লুকাইয়ে ঠাকিলে টুমার লাভ হইবে না। পুলিশ বাড়ি ঘিরিয়াছে।" সাহেবের মুখ রক্তবর্ণ ধারন করলো।
ভেতরে কিছু আওয়াজ পাওয়া গেলো। সম্ভবত পায়ের। তারপর খটাশ করে খিল খোলার শব্দ। বেড়িয়ে এলেন দেবিকাপ্রসাদ। তাঁর সাগরেদরা যখন খোঁজাখুঁজি করে জানালো মন্দির কক্ষে কোথাও কিছু নেই তিনি কিছুক্ষণের জন্য প্রস্তরমূর্তি হয়ে রইলেন। হিসেব কিছুতেই মিলছে না। হ্যাঁ, হতেই পারে তিনি ভুল খবর  পেয়েছেন। কিছু অকর্মণ্য লোক সরকার বাহাদুরের কাছে নিজেদের বিশ্বাসভাজন প্রমাণ করার চেষ্টায় বাজারে আখচার এইসব ভুল খবর রটিয়ে থাকে। কিন্তু তাঁর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে আর সমস্ত অস্বস্তি এসে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে দেবিকাপ্রসাদের অত্যুৎজ্জ্বল দুটো
চোখে। সবেমাত্র মা হারানোর বিষাদ মাখা চোখদুটো যেন বলছে, "সাহেব তুমি আজ এই নিগারের কাছেই হারলে।"
দেবিকা বললেন, "মায়ের সৎকারে দেরী হয়ে যাচ্ছে ছোট সাহেব! আপনার যদি হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমরা এগোতে পারি।"
হার্লড এভাবে কিছুতেই হারবেন না। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো।

হার্লডের মনে তিলে তিলে দানা বাঁধছিলো আর একটা রাস্তা। আচ্ছা, এরমও তো হতে পারে, ছেলেটাকে কোনোভাবে মহিলা র মতো শাড়ি ঘোমটা জড়িয়ে ওই জলসাঘরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। রক্ষণশীল বাঙালি বনেদি বাড়িতে অবশ্য এ জিনিস ভাবাই অস্বাভাবিক। কিন্তু যেখানে স্বয়ং জমিদারের ফেঁসে যাওয়ার প্রশ্ন সেখানে কি পারিবারিক সংস্কার এতটুকু শিথিল হবে না! তিনি জানালেন তিনি সর্বাগ্রে বাড়ির মহিলাদের সাথে কথা বলতে চান। তারপর দেবিকাপ্রসাদ তাঁর মায়ের সব কাজ সম্পন্ন করা শুরু করবেন তবে তা করতে হবে সাহেবের উপস্থিতিতে। দেবিকা বিলক্ষণই জানতেন রানীর জমানায় সাহেবের কথা অগ্রাহ্য করার সাধ্য তাঁর মতো একজন নগন্য জমিদারের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব। তিনি রাজি হলেন তবে এও জানালেন কেউ ঘোমটা তুলবে না আর জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত থাকবেন।

বৈঠকখানার বারান্দার ডানদিকে অর্থাৎ উঠোনের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে প্রমাণ মাপের এই নাচঘর। দেবিকাপ্রসাদের বাবা শিবপ্রসাদের আমলে সত্যিই বসতো মজলিশ। ছেলের সেদিকে কোনোদিন মতি হয়নি। কিন্তু তাঁর গানবাজনা ভালোলাগে। এখন সেই ঘরটায় তাঁর বীণা আর তানপুরা রাখা থাকে। মাঝেমাঝে তিনি সেগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। সবকিছুর মধ্যে হার্লড লক্ষ্য করলেন না কোণের আলমারিটায় অনেক বইয়ের মধ্যে একটি নীলদর্পণও শোভা পাচ্ছে।
নাম কি, কি সূত্রে এ বাড়িতে থাকা হয়, কোনও অপরিচিত লোককে এবাড়িতে আজ দেখেছে কিনা এইসব মামুলি প্রশ্নের ওপরেই চললো জিজ্ঞাসাবাদ। শর্ত অনুযায়ী দেবিকা সেখানে বসলেন। নবীনও হাতে পায়ে জল লাগিয়ে ততক্ষণে চলে এসেছিলো। সাহেবের আধা বাংলা ভাষাকে বাড়ির মেয়েদের কথ্য ভাষায় অনুবাদ করে দিচ্ছিলো। মেয়েরা এমনিতেই শোকস্তব্ধ। তার ওপর ইংরেজ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে সওয়াল জবাব, তাদের তো মুখ দিয়ে কথা সরে না। কোনো মতে পালাতে পারলেই বাঁচে। অন্তঃস্বত্তা কুমুদিনীর তো একেবারে ভিরমি খাবার অবস্থা। কিন্তু শেষ অবধি কেউই ছাড় পেলো না। ব্রজবালা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ সেই অশিতিপর বৃদ্ধারও নিষ্কৃতি হতো না। এদিন দেখার আগে মা মরে বেঁচেছেন - দেবিকা চোখ বুজলেন। এর মধ্যে জমিদার পত্নীকেই একটু যেন স্বাভাবিক লাগলো। হার্লড সাহেবের মন ধীরে ধীরে অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে লাগলো। এই জিজ্ঞাসাবাদের পেছনে তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিলো ঘোমটার আড়ালের মানুষগুলোর কন্ঠস্বর যাচাই করে বোঝা সে আদতেই নারী কিনা। নামমাত্র জেরা শেষ হবার পর তিনি সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত হলেন। কিন্তু মনে একটা হতাশাও আঁচড় কেটে গেলো। এ যাত্রা তাঁর আর নাম করাও হয়ে উঠলো না আর দেবিকাপ্রসাদও কার্যত নির্দোষ। হার্লড একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি তাঁর আর্ধেক বাহিনীকে সকাল অবধি দরজার বাইরে মোতায়েন করে তাঁর বাসস্থানে ফিরে গেলেন। দেবিকা তাঁর মায়ের শেষযাত্রার আয়োজন করতে লাগলেন।
#৩
রাত তখন সাড়ে তিনটে। ছায়ামূর্তির মতো পাঁচজন লোক বেরিয়ে পরলো জমিদারবাড়ির দক্ষিণের দরজা দিয়ে। সাহেবের নির্দেশে অনেক আগেই গ্রামের লোকে বিদায় নিয়েছে। শ্মশানযাত্রী তাই সবাই বাড়িরই লোক।  ইতিমধ্যে বাড়ির বাকি মহিলারা ব্যস্ত হয়ে উঠেছে কুমুদিনীর শরীর নিয়ে। বারান্দায় গিয়ে অলকাসুন্দরী শ্মশানযাত্রীদের উদ্দেশ্যে কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বলে উঠলেন, "দূগ্গা! দূগ্গা!"

শ্মশানের দিকে চলেছেন দেবিকাপ্রসাদ। পিছনে খাটিয়া কাঁধে নিয়ে আসছে নবীন, বলভদ্রর সাথে আর দুজন পুরোনো চাকর। অনেকদূর এগিয়ে এসেছেন তাঁরা। সামনে একটা বড় মাঠ তার বাঁদিকের মেঠোপথে গেলে পরে শ্মশান আর আরেকদিকে ঘন জঙ্গল। কিন্তু শ্মশানযাত্রীর দল মাঠের কিনারে জঙ্গলের প্রান্তে এসে দাঁড়ালো। দেবিকা বললেন, "এখানে।" ধরাধরি করে খাটিয়াটা নামানো হলো মাটিতে।
"সুরেন!" জলদমগ্নস্বর দেবিকার কন্ঠে, "বেড়িয়ে এসো সুরেন!"
সাদা কাপড়ে ঢাকা শবদেহটা একটু নড়লো। তারপর কাপড় সরিয়ে উঠে বসলো আঠেরো কুড়ি বছর বয়সী একটা ছেলে। সে উঠেই চারপাশটা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো। সুরেনের এই অস্থির অবস্থা দেখে দেবিকাপ্রসাদ বললেন, "চিন্তা করো না। আমরা এখন প্রায় তিন ক্রোশ দূরে। এখানে আমরা ছাড়া আর কোনো জনমানুষ নেই।"
তবু কিছু সময় লাগলো সুরেনের ধাতস্হ হতে। ধীরে ধীরে সে বললো, "আপনি আমায় বাঁচালেন জমিদার মশাই। এ বান্দা আপনার এই দান ভুলবে না।" কিছুক্ষণ থেমে সে আবার বললো, "কিন্তু আমার যে বড় ভুল হয়ে গেছে। মন্দির থেকে আমার মালপত্র সব সরিয়ে ছিলাম কিন্তু কার্তুজগুলো কুটুরিতেই রয়ে গেছে।"
দেবিকা হাসলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বার করে আনলেন ছ'টি কার্তুজ। বললেন,"আচ্ছা, এইবার কি জানতে পারি তোমার আসল নাম কি?"
চমকে উঠলো সুরেন। দেবিকা বললেন, "তুমি যে হিন্দু নয় সেটা তোমাদের কত্তামা আগেই বুঝেছিলেন। কিকরে বুঝলে না তো! অবশ্য তা তোমার অজান্তেই হয়েছে। আজ ভোরে দুঃস্বপ্ন দেখে তুমি যখন পানি পানি করে গোঁঙাচ্ছিলে তখন তোমার কত্তামা মন্দিরে পূজোয় বসেছিলেন। সে তোমার কাছে গিয়ে মাথায় হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সবার অলক্ষ্যে মায়ের জন্য আনা গঙ্গাজল তোমার মাথায় ঢেলে ঢেলে তোমায় স্বাভাবিক করে তোলে। তখনই সে বুঝেছে তুমি মুসলমান।"
নবীন কাতর কণ্ঠে কিছু বলতে চাইলো, "এ কি বলছেন কত্তা! তাবলে মন্দিরে রাখলেন? বড় ক্ষতি হয়ে গেলো যে।"
দেবিকা গম্ভীর হলেন, "আঃ! এ নিয়ে মেলা গোল করোনা। ঠিক এই জন্যেই এ কথা পাঁচকান করেনি সে। পরে নাহয় ঠাকুর মশাইকে দিয়ে কিছু একটা শুদ্ধি করে নেয়া যাবে।"
নবীন আবার বললো, "দোষ নেবেন না কত্তা। সবকিছুর কি আর শুদ্ধি হয়! বড়মায়ের দেহটা আপনি উঠোনে কাটা মাটির তলায় রাখলেন যে তার কি শুদ্ধি হবে!"
দেবিকা এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যে স্বপ্ন দেখে তাঁর মা তাঁকে মন্দিরের নাটমঞ্চ তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন সেই  নাটমঞ্চের তলাতেই তাঁর অন্তিম সমাধি হতে চলেছে। সন্তান হয়ে মায়ের মুখাগ্নিটুকুও করতে পারলেন না এই আত্মগ্লাণি তাঁকে  সারা জীবন কুরেকুরে খাবে। মুখে বললেন, "নবীন! হিন্দুশাস্ত্রের কতটুকু তুমি জানো? কিছু একটা বিধান ঠিকই বেড়িয়ে আসবে। আর তাছাড়া করতামই বা কি! একে তো তোমাদের ছাড়া বাড়ির আর কাউকে জানাই নি। আগে সব বললে তোমরাই সব গোল পাকিয়ে দিতে। দেখো, কি আর হবে! আমি মরলে নাহয় নরকে যাবো। বেঁচে থাকতেই বা কি কম নরকে আছি!" নবীন মাথা নিচু করলো।
ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেবিকা আবার সহজভাবে হেসে বললেন, "সে তোমার সুরেন নামটা পছন্দ হলে আমার ডাকতে কোনো আপত্তি নেই।"
"ইকবাল, ইকবাল আহমেদ। কাছারিবাজারের পেছনে জেলেপাড়ায় থাকি। আমাদের মাস্টারদার দল জঙ্গলের মধ্যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। সময়মতো না পোঁছলে ধরে নেবে আমি শহিদ হয়েছি।" ইকবাল দেবিকাপ্রসাদের পাদস্পর্শ করলো৷
দেবিকাপ্রসাদ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, "বন্দেমাতরম্!" ইকবালের চোখের কোণা চিক্ চিক্ করে উঠলো। তারপর সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশ নিরিক্ষন করে বনবেড়ালের মতো জঙ্গলে মিলিয়ে গেলো। দেবিকাপ্রসাদ বললেন, "জয়ী হও, জয়ী করো। ইশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।"

ততক্ষণে সূর্যদেবের আশীর্বাদে পূর্বের আকাশ রক্ত স্নান করতে শুরু করেছে। বাংলার ভাগ্যাকাশে তখন সূর্য তার চিরন্তন তেজে জাজ্বল্যমান।